শতচেষ্টার পরও ‘অক্সিজেনের অভাবে’ রোগীর মৃত্যু, কাঁদলেন চিকিৎসক
সোহেল আহমেদের (৩০) বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ঝলম ইউনিয়নের ওড্ডা গ্রামে। তিনি কাতারে কর্মরত ছিলেন সাত বছর। পাঁচ মাস আগে দেশে চলে আসেন। করোনাকালে কোনো কাজ না পেয়ে কয়েক মাস রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। ঈদুল আজহার দুদিন আগে হঠাৎ তাঁর জ্বর ও কাশি শুরু হয়। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যেতে থাকে। ঈদের পর কুমিল্লা পিপলস হাসপাতালে এক্স-রেসহ কয়েকটি পরীক্ষা করান। রিপোর্ট দেখে চিকিসৎকেরা করোনা হয়েছে বলে কিছু ওষুধ লিখে দেন।
কিন্তু, ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছিল না। একজন পল্লি চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে ভর্তি করা হয় কুমিল্লার জাঙ্গালিয়ায় ন্যাশনাল হাসপাতালে। এক সপ্তাহ পর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৩৭-এ নেমে আসায় গত ৩১ জুলাই দুপুরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সোহেলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে। আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় ন্যাশনাল হাসপাতালের ৩৪ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করতে পারলেও ঢাকায় নেওয়ার মতো তাঁদের হাতে আর কোনো টাকা ছিল না। তাই তাঁরা গত শনিবার বিকেলে সোহেলকে লালমাই উপজেলার বাগমারা ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নেন।
লালমাই উপজেলার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও হাসপাতালের আরএমও ডা. আনোয়ার উল্যাহ রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশনের অবস্থা দেখে ভর্তি না নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু, কুমেক হাসপাতালে সিট খালি না থাকায় বাগমারা হাসপাতালেই রোগীর ভর্তির ব্যবস্থা করতে চিকিৎসকদের অনুরোধ করেন সোহেলের মা ফিরোজা বেগম এবং স্ত্রী খাদিজা আক্তার। এরপর আরএমও’র সম্মতিতে সোহেলকে ভর্তি করিয়ে করোনা ইউনিটের সাত নম্বর বেডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সেবা প্রদান শুরু করা হয়।
এদিকে, বাগমারা হাসপাতালের পাঁচটি খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার (৭.৫ কিউবিক মিটার) রিফিল করে বিকেল ৫টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছার কথা থাকলেও পৌঁছেনি। সন্ধ্যা ৭টায় হাসপাতালের অবশিষ্ট সেন্ট্রাল অক্সিজেনও শেষ হয়ে যায়। তখন সোহেলকে হাসপাতালের রিজার্ভে থাকা দুটি অক্সিজেন সিলিন্ডার (২ কিউবিক মিটার) দিয়ে অক্সিজেন সেবা অব্যাহত রাখা হয়। রাত ১২টার পর ওই দুটি সিলিন্ডারের অক্সিজেনও শেষ হয়ে যায়। তখনও রিফিল সিলিন্ডারগুলো হাসপাতালে পৌঁছেনি। সে সময় আরএমও অনুরোধ করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্য দুজন রোগীর অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে সোহেলকে অক্সিজেন সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এরই মধ্যে রিফিল সিলিন্ডার নিয়ে হাসপাতালমুখী স্পেকট্রা কোম্পানির গাড়িচালককে বার বার ফোন করা হয় সিলিন্ডার নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু, রিফিল নিয়ে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় গাড়িচালক দুঃখপ্রকাশ করে জানান, বাগমারা পৌঁছাতে তাঁর আনুমানিক সকাল ৬টা বাজবে। একই সময়ে আরএমও লালমাই উপজেলার সবকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দায়িত্বশীলদের অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য ফোন করেন। কিন্তু, ওই সময় কোনো সংগঠনের হাতে কোনো রিজার্ভ সিলিন্ডার ছিল না। ভোররাত আনুমানিক পৌনে ৪টায় হাসপাতালে থাকা সব সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। কোনোভাবেই সোহেলকে অক্সিজেন সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অক্সিজেন নিতে না পেরে সোহেল ছটফট শুরু করেন। চোখের সামনে অক্সিজেনের জন্য রোগীর মৃত্যু যন্ত্রণা দেখে আরএমওসহ রোগীর স্বজন, অন্য রোগী ও তাদের স্বজনেরা কান্না শুরু করেন। ভোররাত ৪টার দিকে সোহেল আহমেদ মারা যান।
করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রবিউল আলম বলেন, ‘আরএমও স্যার এই রোগীর জন্য অক্সিজেন সংগ্রহ করতে অনেককে ফোন করেছেন। সারা রাত স্যার করোনা ইউনিটে ছিলেন। রিফিলের গাড়ি সময়মতো পৌঁছালে হয়তো রোগীর মৃত্যু হতো না। মৃত্যুর পর নিজ চেম্বারে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে বসে আরএমও স্যার প্রায় আধা ঘণ্টা কেঁদেছেন।’
সোহেল আহমেদের স্ত্রী খাদিজা আক্তার জুলি বলেন, বাগমারা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা আমার স্বামীকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে চারটি সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধু অক্সিজেনের অভাবে আমরা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়েছি।’
বাগমারা হাসপাতালের আরএমও ডা. আনোয়ার উল্যাহ বলেন, ‘অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু সহ্য করতে কষ্ট হয়েছিল। রাতে অক্সিজেন সংগ্রহের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর দায়িত্বশীলদেরও ফোন করেছি। অবশ্য রোগীর মৃত্যুর এক ঘণ্টা পর রিফিল সিলিন্ডারের গাড়ি হাসপাতালে পৌঁছেছে।’
বাগমারা ২০ শয্যা হাসপাতালটিতে এখনও সরকারিভাবে ইনডোর স্বাস্থ্য সেবা চালু করা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুধু আউটডোর সেবা চালু রাখার নির্দেশনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো ধরনের সরকারি অর্থ বরাদ্দও আসেনি। তারপরও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপির ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং আবুল খায়ের কোম্পানির সহযোগিতায় গত ২৫ এপ্রিল এই হাসপাতালে দুটি আইসিইউ শয্যাসহ মোট ১২টি অক্সিজেন শয্যা স্থাপন করা হয়। সেন্ট্রাল অক্সিজেনের আওতায় জরুরি বিভাগেও দুটি অক্সিজেন শয্যা স্থাপন করা হয়। সে সময় আবুল খায়ের কোম্পানি থেকে সাড়ে ৭.৫ কিউবিক মিটারসহ মোট ১২টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দেওয়া হয়। গতকাল রোববার (১ আগস্ট) সকাল পর্যন্ত এই হাসপাতালে ১০ জন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন।