স্বপ্নের ইতালি : মৃত্যু-মুক্তিপণের ফাঁদে ভৈরবের কয়েকশ পরিবার
পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে স্বপ্নের ইতালি যাত্রায় কিশোরগঞ্জের ভৈরবে সক্রিয় বেশ কয়েকটি মানব পাচারকারীচক্র বা দালাল গ্রুপ। তাদের খপ্পড়ে পড়ে, প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে শত শত যুবকের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। লিবিয়ায় মাফিয়াচক্রের হাতে জিম্মি হয়ে অমানসিক নির্যাতন সহ্যসহ দিতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ।
মুক্তিপণের টাকা চাহিদা ও সময় মতো না দিতে পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে বাধ্য হচ্ছে অনেক স্বপ্নদেখা তাজা প্রাণকে। পরিবারগুলিকে মাথায় নিতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। ঋণের চাপে অনেক পরিবার ভিটে-মাটি হারা। কেউ আবার ফেরারি জীবন যাপনে হচ্ছে বাধ্য।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভৈরবে লিবিয়া হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালি পাঠানোতে কাজ করছে মানব পাচারচক্রের বেশ কয়েকটি গ্রুপ। এদের মধ্যে পৌর এলাকার দক্ষিণ জগন্নাথপুরের খোকন মাহমুদ, তাঁতারকান্দির জুয়েল, জগন্নাথপুরের জাফর, লক্ষ্মীপুরের উজ্জ্বল, মধ্য জগন্নাথপুরের পিন্টু, শিবপুর ইউনিয়নের শম্ভুপুর গ্রামের জুনায়েদ, কালিকাপ্রসাদ পশ্চিম পাড়ার সোহাগ, শ্রীনগরের তানভিরুল অন্যতম।
তবে এসব দালালদের কেউই দেশে বসবাস করেন না। তারা সবাই লিবিয়ায় থাকেন এবং দীর্ঘদিন ধরে দেশে আসেন না। তারা নিজেদের হিসাব নম্বর, পরিবারের লোকজন এবং মনোনীত লোকদের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করে থাকেন বলে ভুক্তভোগীরা জানান।
প্রথমে এদের পরিবারের সদস্য এবং মনোনীত লোকজনের সহায়তায় টাকা গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া হয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপের দেশ ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে বেকার যুবকদের সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকায় লিবিয়া পাঠানো হয়।
পরে সেখানে যাওয়ার পর লিবিয়ার স্থানীয় লোকজনের যোগসাজসে বাংলাদেশিদের অজ্ঞাত স্থানে আটক করে পাসপোর্ট এবং সঙ্গে থাকা ডলার কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর আটককৃতদের ওপর চালানো হয় অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। বলা হয় দেশ থেকে অভিভাবকদের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ এনে দিতে। এরমধ্যে দেশে থাকা অভিভাবকরা সন্তানদের খোঁজ-খবর না পেয়ে অস্থির দিন কাটাতে থাকেন। ছুটতে থাকেন দালালদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বাড়ি। কিন্তু তেমন কোনো সহায়তা তারা তখন পান না।
নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে লিবিয়ায় আটকে থাকারা দেশে তাদের অভিভাবকদের ফোন করে দুর্দশা এবং মুক্তিপণ না দিলে তাদের জীবন বিপন্ন হবে বলে কান্নাকাটি করেন। তখন অভিভাবকরা ঋণ এবং জমি-ভিটে বিক্রি করে দালালদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অথবা এদের পরিবারের সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেন টাকা। তখন যাদের মুক্তি মেলে তাদের কেউ নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরে আসে। আর যারা দালালদের দাবিকৃত টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয় অথবা আংশিক পরিশোধ করেন, তাদের সন্ধান পাননা পরিবারের লোকজন। অনেক সময় বজ্রপাতের মতো তাদের মৃত্যু সংবাদ আসে পরিবারগুলির কাছে।
গত বছরের ২৮ মে এমনি এক মর্মান্তিক ঘটনা বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে নাড়িয়ে দেয়। সেদিন লিবিয়া থেকে ইতালি গমনেচ্ছুক ২৬ জন বাংলাদেশিকে একটি মাফিয়াচক্র ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। যার মধ্যে ভৈরবের ছয়জন নিহত হন। আহত হন আরও তিনজন। আর এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ আছে দুইজন। হতাহতের পরিবারগুলিতে এখনও চলছে বুকফাটা মাতম।
ভৈরব বাজার দক্ষিণ ঋষিপট্টি এলাকার অধীর দাসের ছেলে রাজন দাস (২৭) নিহত হন ওই ঘটনায়। পরিবারটিতে এখনও চলছে আহাজারি। ছেলের লাশ বা শেষবারের মতো মুখটিও না দেখার আক্ষেপ অধীর চন্দ্র দাস আর মিনা রাণী দাসের। রাজনের চার বছর বয়সী একমাত্র কন্যা শিশু ঐশী রানি জানে তার বাবা বিদেশ আছেন। বিমানে করে দেশে ফিরবেন।
তারা জানান, জগন্নাথপুরের দালাল জাফরের মাধ্যমে চার লাখ টাকার চুক্তিতে তার ছেলে লিবিয়া যায়। সেখানে মাফিয়াচক্রের হাতে জিম্মি হওয়ার পর রাজন ভিডিওকলে জানায়, পাঁচ লাখ টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলবে। এই কথা শুনে তারা দ্রুত ঋণ করে জাফরের ফুফাত ভাই জুয়েলের হাতে চার লাখ টাকা তুলে দিলেও সন্তানের জীবন রক্ষা করতে পারেননি।
উপজেলার রসূলপুর গ্রামের মেহের আলীর ছেলে আকাশ (২৬) নিহত হন ওই ঘটনায়। শ্রীনগর গ্রামের দালাল তানভিরুলের মাধ্যমে আকাশ লিবিয়া যায়। সেখান থেকে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে ত্রিপুলী যাওয়ার পথে জিম্মি হন এবং মুক্তিপণের টাকা পরিশোধের আগেই মাফিয়াচক্রের হাতে নিহত হন।
নিহত আকাশের বড়ভাই বেক্সিমকো ফার্মার কর্মকর্তা মো. মোবারক হোসেন জানান, জিম্মির ঘটনা জানার পর তানভিরুলের সঙ্গে বহু চেষ্টায়ও যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি ভাই হত্যার দায়ে তানভিরুলসহ তার দেশে থাকা দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তারা জেলে আছেন। তনি তার ভাই হত্যায় জড়িত দালালচক্রের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন।
এদিকে, গত ১৩ এপ্রিল উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শম্ভুপুর গ্রামের দালাল জুনায়েদের মাধ্যমে লিবিয়া যায় ভৈরবপুর উত্তরপাড়ার মুজাহিদ পাঠান ইমন। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন। পিতৃহীন ইমন বিধবা মা আর দুই বোনকে নিয়ে তাদের পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু ৯ মে তিনি ত্রিপুলীতে ভৈরবের আরও তিন যুবকের সঙ্গে মাফিয়াচক্রের হাতে জিম্মি হন। জিম্মিদশায় তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। দাবি করা হয় ১৩ লাখ টাকা। নির্যাতনের ভিডিও দেশে পাঠালে পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় দালাল জুনায়েদের সঙ্গে। কিন্তু জুনায়েদ ইমনকে মুক্ত করার কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেননি। পরে রংপুরের এক লোকের মাধ্যমে টাকা দিয়ে মুক্ত করা হয়। বর্তমানে সেই লোকের জিম্মায় ইমন সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানায় তার পরিবার।
মানব পাচারচক্রের সদস্যদের এই অপতৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুবনা ফারজানা বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা বিদেশ গমণেচ্ছুক বিশেষ করে ইউরোপের দেশ ইতালি যাত্রা প্রত্যাশীদের বলি, দালালচক্রের মাধ্যমে না গিয়ে বৈধভাবে যাওয়ায় উদ্যোগী হতে। কিন্তু তাদের অনেকেই আমাদের কথা না শুনে বিপদের মুখে পড়ছেন। তিনি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদেশ যেতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।