এনটিভির লোগো এবং আমার ১৮ বছর আগের সেই দিনগুলো
উচ্চ আদালতের আদেশে ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট ইটিভি বন্ধ হওয়ার দিনটা পরিষ্কার মনে আছে। ডালিমের কান্নাভেজা স্বরে শেষ নিউজ কাস্ট, ট্রান্সমিশন বন্ধ করে দেওয়া, কান্নারত সহকর্মীদের চোখে অবিশ্বাস আর শোকের কোলাজ… ঝাপসা হলেও এখনও চোখে ভাসে!
ইটিভির গ্রাফিক্স টিমের প্রধান হেলাল ভাই, আমি, মিঠু, শাহীন, হুদা আর বিল্লা ভাই মিলে ছয় জনের এই টিম। বন্ধ হওয়ার পরেও আমরা ডিসেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত আসা-যাওয়া করেছি। আড্ডা আর টেবিল টেনিস খেলে সময় কাটত আর খোঁজখবর নিতাম কে কোথায় যাওয়ার চেষ্টা করছে, নতুন কোনও টিভি চ্যানেল আসছে কি না। বিল্লা ভাই বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিল বেশ কিছুদিন ধরে, শেষ পর্যন্ত চলেই গেল। হেলাল ভাই একদিন ক্যানটিনে ডেকে বললেন, তিনি গ্রামীণফোনে যাচ্ছেন বেশ বড় পদে। খুশি হলেও আমরা নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে টেনশনে ছিলাম।
এরই মধ্যে একদিন শুচি ভাই (হাসনাইন খুরশেদ) আলাদা করে ডেকে বলল, ‘খালু, আমি একটা নতুন চ্যানেলের জন্য চেষ্টা করছি। গ্রাফিক্সে কিন্তু তোমাকে ধরেই টিম গোছাচ্ছি। তুমি তোমার টিম রেডি করো।’ ভালো কথা, তখন সবাই মজা করে আমাকে ‘খালু’ বলে ডাকত। এর পর থেকে প্রায়ই ফোনে বা কোনও কফিশপে শুচি ভাইয়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা হতো। কোন কোন জায়গায় কাকে কাকে নেওয়া যায়, কাকে না হলে চলবে না, কাকে কীভাবে কনভিন্স করা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কার চ্যানেল, কে চেয়ারম্যান বা এমডি, সেটা খালু কিছুতেই খোলাসা করে না।
এদিকে, আমি বিষয়টা গ্রাফিক্সের বাকি তিন জনকে জানিয়েছি। ওরা তিন জনই চারুকলার পুরোনো বন্ধু। কারও কারও অন্য কোনওখানে কথাবার্তা চললেও তেমন কনফার্ম কিছু ছিল না। এর মধ্যে হুদার উত্তেজনা ছিল বেশি, ‘রবি ভাই, কোনও ব্যাপার না, আমরা ঠিক চালিয়ে নেব, টেনশন কইরেন না!’ এ ধরনের সাহস দেখাতে সে কার্পণ্য করত না। তার দরকারও ছিল হয়তো। কারণ, ইটিভির স্টেশন আইডি আর বাম্পার ভারত থেকে অনেক অর্থ ব্যয় করে আনা। স্থানীয়ভাবে সেটা করার মতো কারিগরি সুযোগ আর ব্যক্তিগত দক্ষতা কোনওটাই তখন আমাদের ছিল না। তাই এ দুটো ভারত থেকেই করা হবে, এই শর্তে শুচি ভাই রাজি হওয়ার পরেই আমরা ২০০৩ সালের ১৫ জানুয়ারি বনানীর ইকবাল সেন্টারে গিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে আসলাম। সেটা বিল্ডট্রেড নামে একটা প্রতিষ্ঠান, তার কর্ণধার এনায়েতুর রহমান বাপ্পী, তিনিই নতুন চ্যানেলের এমডি, যাঁর দাপ্তরিক নাম ইন্টারন্যাশনাল টেলিভিশন চ্যানেল লিমিটেড আর বাণিজ্যিক নাম হবে ‘এনটিভি’।
কয়েক দিন পর হুদাকে তার ভূতের গলির মেস থেকে তুলে গেলাম ইকবাল সেন্টারে, সাথে সম্ভাব্য কয়েকটা লোগোর ডিজাইন। তত দিনে সাবেক ইটিভির জনপ্রিয় প্রেজেন্টার আর রিপোর্টারসহ অনেকেই এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে। বাপ্পী ভাইসহ আরও কয়েক জনের উপস্থিতিতে লোগো নিয়ে আলোচনা হলো, ডালিমের পরামর্শে একটা ডিজাইনের অল্প একটু পরিবর্তন করে তখনই প্রিন্ট দিয়ে সবাইকে দেখালাম। সবার সম্মতিতে সেটাই নির্ধারিত হলো, যা আজ প্রায় ১৮ বছর ধরে দেশে এবং বিদেশের বাঙালি দর্শকের কাছে অতি পরিচিত নাম।
এরপর বিএসইসি ভবনে স্থায়ীভাবে কর্মযজ্ঞ শুরু। ছোট একটা ঘরে আমরা চার জন গ্রাফিক্স নিয়ে ব্যস্ত, প্রোগ্রাম আর নিউজ বিভাগের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছি। সাথে সেটের উৎকণ্ঠা। ঠিক বাইরে প্রতিদিন যন্ত্রপাতি আসছে, আর্থস্টেশন বসছে, স্টুডিও রেডি হচ্ছে, এডিট প্যানেল, নিউজরুম ধীরে ধীরে চেহারা পাচ্ছে। এদিকে, আমি ভারতের নামকরা কয়েকটা গ্রাফিক্স ফার্মের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি স্টেশন আইডি আর বাম্পার নিয়ে। কিন্তু উদ্বোধনের কিছুদিন মাত্র আগে হঠাৎ জানানো হলো যে ভারত থেকে গ্রাফিক্স করা হবে না, যা করার আমাদেরই করতে হবে। কোনও কারণ জানানো হলো না। আমাদের তো মাথায় বাজ! মিঠু আর শাহীন ভয়ে পিছিয়ে গেল। আবারও সামনে এসে সাহস জোগাল হুদা, ‘রবি ভাই, আমরা যা পারি তাই বানাব, ভালো হোক মন্দ হোক আমরাই বানাব।’ নিজ থেকেই ও স্টেশন আইডি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আর আমি বাম্পার নিয়ে। আমার অল্প একটু সাহায্য ছাড়া প্রায় একার হাতেই ও শেষ করলে ওর কাজ। এত দিন পরেও হঠাৎ টিভি চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে এনটিভির স্টেশন আইডি-বাম্পার চোখে পড়লে হাত থেমে যায়, প্রায় অবিশ্বাস নিয়ে ভাবি, কী একটা অসম্ভব কাজকে সেদিন আমরা এক তুড়ি মেরে সম্ভব করে তুলেছিলাম। ভালো-মন্দের বিচার দর্শকেরা করুন, আমি শুধু পেছনের গল্পটাই জানিয়ে রাখি।
৩ জুলাই এনটিভি ১৮ পেরিয়ে ১৯ বছরে পদার্পণ করেছে। এমন শুভ ক্ষণে সাবেক ও বর্তমান সব সহকর্মীকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভ কামনা। এ কথা আজ গর্ব করে বলতেই পারি, ১৮ বছর আগে নতুন কিছু করার স্বপ্ন আর নিজেদের যোগ্যতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তাগিদ নিয়ে কিছু টগবগে তরুণ-যুবা যে উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আমিও ছিলাম সে কাতারের সামনের একজন। আজও হয়তো এনটিভির সিঁড়িঘরে কোনও পুরোনো আসবাবের নিচে পড়ে আছে আমার ফেলে রাখা কোনও স্মৃতির অংশ—সে সময়ের উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনার সাক্ষী হয়ে।
লেখক : সাবেক গ্রাফিক্স ইন-চার্জ, এনটিভি; বর্তমানে হেড অব গ্রাফিক্স, দেশ টিভি