এনটিভি ছিল পাঠশালা
হঠাৎ করেই টেলিভিশনে যোগ দেওয়া। ২০০৩ সালের শেষের দিকে। স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) পরীক্ষার শেষ দিন, শিক্ষক সামিয়া রহমান একটি মুঠোফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বললেন। এনটিভির নির্বাহী পরিচালক হাসনাইন খুরশেদ শুচি ভাইয়ের সঙ্গে বেশ ভয় মেশানো কণ্ঠেই ছিল আলাপচারিতা। বনানীর ইকবাল সেন্টারের অস্থায়ী অফিসে দেখা করলাম, পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই পেয়ে গেলাম এনটিভির সাথে কাজ করার সুযোগ। এনটিভির সঙ্গে সাত বছরে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে দেশের বড় বড় ঘটনা। মানুষ চিনতে শিখেছি এই সময়টায়। অভিজ্ঞ হয়েছি আগের চেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও অনেক বেশি শিখেছি এই সময়টায়।
‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ শায়খ আব্দুর রহমানকে গ্রেপ্তার অভিযান
২০০৬ সালের ১ মার্চ, আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ঘুম থেকে উঠেই দেখি জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমানকে পরিবারসহ ঘিরে রাখা হয়েছে সিলেটে। তড়িঘড়ি করে চলে যাই অফিসে। সিনিয়র-জুনিয়র সব চলে এসেছে, অফিসে তখন চরম উত্তেজনা। সরাসরি সম্প্রচারযন্ত্র ডিএসএনজি ঘটনাস্থলে চলে যাওয়ায় সবার আগে সবশেষ খবর প্রচার করছে এনটিভি। ক্রাইম রিপোর্টার আহমেদ সাগর একের পর এক তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন ঘটনাস্থল থেকে। সবার চোখ এনটিভির পর্দায়। কারণ, শেষ পর্যন্ত কোনও টিভিই সরাসরি সম্প্রচারে যেতে পারেনি অতিরিক্ত ডিএসএনজি না থাকায়। ছিল না ইন্টারনেট দিয়ে ছবি পাঠানো বা সম্প্রচারের ভালো সুযোগ।
এমন সুযোগ ছাড়তে নারাজ এনটিভির সিনিয়ররা। কিন্তু আহমেদ সাগর আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, কাউকে তিনি দেখতে চান না সিলেটে, বিশেষ করে সিনিয়রদের। নির্বাহী পরিচালক চাপের মুখে। সব রিপোর্টার চেষ্টা করছেন সুযোগটা পেতে। তখন আমার মাত্র দুই বছরের অভিজ্ঞতা। আমি কিছুটা চুপচাপ মানুষ। সুযোগটা কাজে লাগালাম। শুচি ভাইকে বোঝাতে পারলাম, আমি গেলে আহমেদ সাগর হয়তো কিছু বলবেন না। আর তাঁর একার পক্ষে সব দিক সামাল দেওয়াও সম্ভব হবে না, এটা তো তিনি ভালোই বুঝতেন। কিছুটা ভাবলেন, অনুমতি দিয়ে দিলেন।
ক্যামেরাম্যানসহ দ্রুত যা যা প্রয়োজন নিয়ে রাওনা হয়ে গেলাম সিলেটের দিকে। সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় গায়ে ছিল টি-শার্ট। রাজধানীর কাকরাইলের পলওয়ে মার্কেট থেকে কিনে নিলাম এক রঙের শার্ট। টাকা দিয়েছিলেন নির্বাহী পরিচালক, যা এখনও ফেরত দেওয়া হয়নি।
সিলেট পৌঁছাতে রাত ৯টা হয়ে গেল। ঘটনাস্থল সিলেট নগর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে টুলটিকর ইউনিয়নের পূর্ব শাপলাবাগ আবাসিক এলাকায় আবদুস সালাম সড়কের ২২ নম্বরে ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’। গিয়ে তো অবাক। পুরো বাড়িকে ঘিরে আছে অস্ত্রধারী র্যাবের সদস্যরা। সংস্থার গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল গুলজার উদ্দিন নেতৃত্বে। আহমেদ সাগর তখন রাতের খবরের সরাসরি তথ্য জানাচ্ছেন। আর জনপ্রিয় সব টিভি সাংবাদিককে দেখলাম বিব্রত অবস্থায় ঘুরছেন, এনটিভির সাথে কিছু করতে না পারায়। কেউ বা গল্প করছেন। সাগর ভাই আমাকে দেখার সাথে সাথে জানালাম তাঁকে সহায়তা করতেই গিয়েছি। তিনি তখন সম্ভবত প্রায় ২০ ঘণ্টার মতো নির্ঘুম সময় পার করছেন। রাতের খাবার আর বিশ্রাম নেওয়ার অনুরোধ করলাম তাঁকে। কিছু হলে আমি সাথে সাথেই ফোন করে জানাব বলাতে কী মনে করে হোটেলে চলে গেলেন। রাত কিছুটা বাড়ার পর অধিকাংশ রিপোর্টার, বিশেষ করে টিভি রিপোর্টাররা চলে গেলেন বিশ্রাম নিতে।
গোটা রাত যতটা সম্ভব ঘুরে দেখেছি বাড়ির চারপাশ। বাড়িটির বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়ায় কেমন যেন ভূতুড়ে লাগছিল সব। নতুন কিছু কাজ না থাকায় দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে খবরাখবর নিয়েছি। বুঝতে চেষ্টা করেছি তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা। এমন সময় এক র্যাব সদস্য আতরের গন্ধ পান। কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। ধারণা করা হয়, হয়তো শায়খ আব্দুর রহমান আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন। পরে খুঁজে পাওয়া যায় একজন ফটো সাংবাদিক আতর মেখেছেন। এরপর রাতটা মোটামুটি একই গেল।
ভোরের দিকে বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়চারি করছিলাম, এমন সময় হঠাৎ হইচই! বাড়ির এক পাশের বারান্দায় দেখা মিলল ধূসর রঙের পাঞ্জাবি পরা শায়খ আব্দুর রহমানকে আর তাঁর সাথে থাকা দুজনকে। শুরু হল কথোপকথন। আমি ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম ঢাকায়। ফোন দিলাম সাগর ভাইকে। কথোপকথনে, আত্মসমর্পণ করবার কথা বার বার বলার এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসতে রাজি হন শায়খ আব্দুর রহমান। কিন্তু একটি শর্ত ছিল তাঁর। ধরা দেওয়ার আগে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে চান। সেই শর্তে রাজি হয়ে যান অভিযানকারীরা। এরপর বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে এলে আটক করা হয়। কিন্তু তাঁকে আর কথা বলতে দেওয়া হয়নি গণমাধ্যমের সঙ্গে। সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে শায়খ রহমানকে বের করে আনতে সময় লেগেছিল ৩৩ ঘণ্টা।
এরই মাঝে আমি সরাসরি সম্প্রচারের জন্য উঠে পড়ি ঠিক সামনের বাড়ির ছাদে। একতলা ছাদ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল সব। শায়খ রহমান ও তাঁর সঙ্গীদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কালো কাচে ঢাকা র্যাবের গাড়িতে। গণমাধ্যম প্রথমবারের মতো সুযোগ পেল বাড়ির ভেতর দেখবার। ভেতরে ঢুকে দেখি পুরো বাড়ি ওলটপালট। সাধাসিধে আসবাব ছাড়া কিছু বৈদ্যুতিক তার ছড়িয়ে আছে চারপাশে। দ্রুত ছবি নিয়ে চলে যাই সিলেটের র্যাবের অফিসে। সাগর ভাই রয়ে যান ঘটনাস্থলে।
এরপর আদালতে হাজির করা হয় আটক সবাইকে। কঠোর পাহারায় ঢাকায় রওনা হয়ে যায় গাড়িবহর। সেদিন হরতাল চলছিল। উপস্থাপক শামসুদ্দিন হয়দার ডালিমের সাথে গোটা পথে ছিল দফায় দফায় টেলিফোনে তথ্য দেওয়া। পথের মাঝে একবার গাড়ি থামানো হয়। সবাই সতর্ক হয়ে যাই, র্যাবের গাড়ি হঠাৎ থামানো, তখন যে কোনও অঘটনের কারণ হতে পারত। প্রাকৃতিক টান ছিল শায়খ আব্দুর রহমানের। শেষ পর্যন্ত গাড়ি পৌঁছায় উত্তরায় র্যাবের অফিসে। শেষ হয় আমার দিকের আব্দুর রহমান ও তাঁর সহযোগীদের সংবাদ সংগ্রহের পালা।
প্রায় ৩৫ ঘণ্টা জেগে আছি, প্রথম অনুভব করলাম। ফিরে যাই কারওয়ান বাজারে এনটিভির অফিসে। সবাই বেশ প্রশংসা করেছিল মনে আছে, যা সব ক্লান্তি আবারও ভুলতে সাহায্য করল। আহমেদ সাগর প্রথম থেকেই অভিযানে ছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যার খবরের আগে তিনি ঢাকায় পৌঁছাতে না পারায় আমি স্টুডিওতে উপস্থাপকের সাথে যোগ দিলাম। নানা প্রশ্ন করেছিলেন ডালিম ভাই, মনে আছে। জীবনের প্রথম স্টুডিওতে আলোচনায়, সেই সঙ্গে এত বড় সময় নিয়ে ঘটনার সাথে থাকা। অভিযানটি খুব সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম বড় ধরনের জঙ্গিবিরোধী অভিযান, যেটা চলেছিল ৩৩ ঘণ্টা এবং টেলিভিশনের ইতিহাসেও খুব সম্ভবত দীর্ঘতম সময়ের সারসরি সম্প্রচার। এমন অভিজ্ঞতা টেলিভিশন সাংবাদিকতায় খুব কমই আসে। আমি ছিলাম সেই ভাগ্যবানদের একজন।
এরপর ঠিক চার দিন পর, ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তার করে র্যাবের সদস্যরা। সে বার আর সরাসরি সম্প্রচারের সুযোগ পাইনি আমরা। সিনিয়রদের দখলে ছিল তা। তবে আমি ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ক্যামেরাম্যান তানভিরকে সাথে নিয়ে মুক্তাগাছায়। যে বাড়ি থেকে আটক করা হয় বাংলা ভাইকে। রাতের নিউজে এসে প্রতিবেদনটি ধরাতে পেরেছিলাম। এর পর দেশের বড় বড় ঘটনায় সারসরি সম্প্রচারের সুযোগ পেয়েছিলাম সহজেই।
এক-এগারো
২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি, জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অবস্থা কোন দিকে গড়ায়, তা বের করে আনতে এনটিভি সন্ধ্যায় এক বিশেষ অনুষ্ঠান করে। চার জন রিপোর্টার ছিলেন চার গুরুত্বপূর্ণ নেতার সাথে। আমার দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা তোফায়েল আহমেদের বাসায়। অনুষ্ঠানে পরিস্থিতি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না পেলেও কাজ শেষে আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে কিছুটা ইঙ্গিত পেলাম পরদিন বড় কিছু হতে যাচ্ছে। ১১ জানুয়ারি সকাল থেকেই খোঁজ রাখলাম। তথ্য পেয়ে বিকেলে চলে গেলাম বাংলাদেশে নিযুক্ত সেই সময়ের কানাডার রাষ্ট্রদূতের বাসার সামনে। একে একে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীর নেতাসহ বাংলাদেশে দূতাবাস আছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো মোড়ল দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের দেখলাম বাসায় যেতে। আলাদা আলাদা বৈঠকে হলো। জরুরি অবস্থা জারিসহ নতুন ধরনের সরকার ব্যবস্থায় রাজি হলেন নেতারা। আমি প্রথমেই গিয়েছিলাম ঘটনাস্থলে। হয়তো বেশিই গুরুত্ব দিয়েছিলাম তাই। এরপর একে একে এলেন অন্য সাংবাদিকেরা। রাজনীতির পট পরিবর্তন দেখলাম একের পর এক। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দেখলাম। দেখলাম, সারা দেশ যখন চুপ মেরে গিয়েছিল, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কীভাবে বিক্ষোভ করেছিল। দেখেছি নেতাদের রূপ পরিবর্তন।
ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার তাণ্ডব
বিকেলে বাগেরহাট পার হয়ে সন্ধ্যার ঠিক আগে পৌঁছালাম শরণখোলায়। আগের কোনও কিছুর সাথে মেলাতে পারলাম না। সে কী তাণ্ডব। গাছে মানুষের লাশ। ঘর-বাড়ির চিহ্ন নেই। গাছপালা দুমড়েমুচড়ে আছে। অসহায় মানুষ বসে আছে খোলা আকাশের নিচে। খাবার নেই, পানি নেই। টিউবওয়েল উপড়ে ফেলেছে সিডর। নোনা পানিতে তলিয়ে আছে সব। ২০০৭ সালের নভেম্বরের কথা। সরকারি হিসাবে প্রায় ছয় হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। রেডক্রিসেন্টের হিসাবে প্রায় ১০ হাজার। সেই সন্ধ্যায়, শেষ আলোতে যতটা পারা যায় ছবি তুলে, গাছের নিচে বসে কণ্ঠ দিয়ে টেপ পাঠিয়ে দিলাম রাতের বাসে। তখন ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে ছবি পাঠানো যেত না।
পরদিন দিনের আলোয় চোখে পড়ল আরও কঠিন দৃশ্য। খালের পানিতে গরু-ছাগলের সাথে মানুষের লাশ ভেসে যাচ্ছে। মৃত বাচ্চা নিয়ে মা পাথরের মতো হয়ে গেছেন। দাফন দেওয়ার মানুষও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। মানুষ পানি আর খাবারের আশায় যাকে দেখছে তার কাছেই ছুটে যাচ্ছে।
প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কখনও নৌকায়, কখনও পায়ে হেঁটে খবর সংগ্রহ করে পাঠিয়েছি। প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায় দেখেছি। শরণখোলায় একমাত্র বোর্ডিংয়ে থেকেছি আমি আর ক্যামেরাম্যান। ভাড়া ছিল ১৫ টাকা প্রতি রাত। খাবার খেয়েছি যখন যা পেয়েছি। জীবন কত কষ্টের বুঝতে শিখেছি সেই সিডরের সময়টায়।
সে সময় সহকর্মী শাহেদ আলমের প্রতিবেদন ছিল দেখার মতো। দুবলার চর থেকে শুরু করে বাগেরহাট ও বরিশালের অনেক অংশ ঘুরে বেরিয়েছে শাহেদ।
তার দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৫ মে আবারও উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। খুলনার দাকোপে যেতে পেরেছিলাম অনেক কষ্টে। চারদিকে পানি, কিন্তু মানুষ পানির অভাবে দিশেহারা। নোনতা পানি ভরে গেছে চারপাশ। সে সময় উপকূলে প্রায় তিন লাখ মানুষ ঘরহারা হয়। সুন্দরবন বাঁচিয়ে দেয় অধিকাংশের জীবন। এখনও সেসব মানুষের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। প্রকৃতি যে মানুষকে কঠিন সাজা দেয়, তা দেখেছি সিডর ও আইলায়।
নির্বাচন ও রাজনীতি
এক-এগারোর ঠিক আগে নির্বাচনি পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছিল সিলেট বিভাগে। গাড়িতে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার ঘুরেছি তিন জেলা—হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটে। গাড়ি ও নৌকায় মিলিয়ে আরও পথ সুনামগঞ্জে। ভোটারদের সমস্যাগুলো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে প্রথম। বড় বড় অনেক নেতাই কী করে সাধারণ মানুষকে উন্নয়নের কথা বলে ভুলিয়ে রাখে, তা দেখেছি মাঠে গিয়ে। অন্যদিকে, ভোটারদের কাছে যোগ্য মানুষ কারা, তার একটা ধারণা ও ভোটের হিসাব-নিকাশ কী হতে পারে তুলে আনতে চেষ্টা করেছিলাম, যা আমার জন্য ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। জাতীয় নির্বাচন কাভার করতে গিয়ে কিন্তু নিজের ভোটটি দিতে পারিনি কখনওই। অন্যান্য নির্বাচনেও মাঠে থাকার সুযোগ হয়েছিল। ভোট ও রাজনীতি কাভার করতে গিয়ে কৌশল, কূটকৌশল, প্রভাব, অর্থ আর শক্তির খেলা দেখার সুযোগ হয়েছে।
ভাষা ও বিজয়ের মাস
শেরপুরের বিধবাদের গ্রাম। আগেও প্রতিবেদন হয়েছে, তবে টিভিতে চোখে পড়েনি। প্রস্তাব দিতেই পাস হয়ে গেল। প্রযোজক শাহাবুদ্দিন ভাই আর আমি গেলাম শেরপুরে। খুঁজে পেলাম স্বামীহারা যোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় খুঁজে খুঁজে স্বাধীনতার পক্ষে থাকা পুরুষদের মেরে ফেলা হয়। পুরুষশূন্য সেই গ্রামে নারীরা কতটা কষ্টের মাঝে কাটাচ্ছে না দেখলে বোঝা কষ্টের। শুধু যে তাদের কথা বা স্মৃতির কথা প্রকাশ করলাম, তা নয়। খুঁজে বের করেছি সেই মানুষগুলোর একজনকে, যে হত্যার সাথে জড়িত ছিল। এরপর ভাষা, স্বাধীনতা আর বিজয়ের মাসে আমার বিশেষ কাজ ছিল ইতিহাস ও এর সাথে জড়িতদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা। ভাষার মাস নিয়ে কাজ করার সময় নতুন অনেক কিছু জেনেছি। একবার ২১ দিনের টানা প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব ছিল। তামান্না মজুমদারকে সাথে পেলাম তা তৈরিতে। হয়তো কিছুটা হলেও আড়ালে থাকা মানুষগুলোকে আমরা সামনে আনতে পেরেছিলাম অনেক দিন পর। বিশেষ করে টিভিতে।
প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ
এনটিভিতে আমার শুরু বাণিজ্য ও তথ্য-প্রযুক্তি ডেস্ক দিয়ে। নিয়মিত সংবাদের পাশাপাশি ‘রাইট ক্লিক’ নামের একটি অনুষ্ঠান তৈরিতে কাজ করতে হয়েছে আমাকে। খুব সম্ভবত এনটিভির নিজস্ব প্রযোজনায় প্রথম অনুষ্ঠান, যা বিজ্ঞাপন পেতে শুরু করে। এমনটাই শুনেছিলাম ডেস্কের প্রধান আমিনুর রশীদের কাছে। আমি প্রচুর সিনেমা দেখতাম আর গান শুনতাম আগে থেকেই। অনুষ্ঠান তৈরিতে তা কাজে লেগেছে। ‘রাইট ক্লিক’ আমার প্রথম প্ল্যাটফর্ম, যেখানে আমি তা প্রয়োগের সুযোগ পাই। আমি এখনও চেষ্টা করি নতুন কিছু করতে।
নিজের পরিবর্তন
সাংবাদিক হতে গেলে অনেক শক্ত হতে হয়, পেশায় যোগ দিয়ে বুঝতে পেরেছি। আর টেলিভিশন সাংবাদিকতায় প্রায় সব ধরনের রিপোর্ট নিয়েই কাজ করতে হয়। ফলে অভিজ্ঞতাটাও হয় নানা রকমের। আমি অপরাধ-সংক্রান্ত খবর কখনওই সংগ্রহ করতে চাইতাম না। কিন্তু অফিসে যখন কেউ থাকত না অথবা রাতের পালায় যখন আমার দায়িত্ব থাকত, তখন বাধ্য হয়ে খোঁজ রাখতাম অপরাধ জগতের।
লাশ দেখলে আমার ঘুম হতো না। একদিন লালবাগে এক সন্ত্রাসীকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে, খবর সংগ্রহের জন্য যেতে হলো। ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ পাইনি। গেলাম ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। জীবনের প্রথম। তীব্র গন্ধ ঢোকার মুখেই। ক্যামেরাম্যান আমাকে ছাড়া ভেতরে ঢুকতে রাজি হলো না। অগত্যা ভেতরে ঢুকেই দেখি অনেক মৃতদেহ। একজনের চামড়া কেটে ফেলা হয়েছে, একজনের মাথার চুল। ডোম জানতে চাইল, কোন লাশ। নাম বলতেই দেখিয়ে দিল। কাছে গিয়ে চারটা গুলির পোড়া স্থান গুনে দেখেছি। এরপর আবার ঘটনাস্থলে। স্বজন, আশপাশের মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে অফিসে ফিরে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কাউকে বলা সম্ভব হয়নি। বাসায় ফিরে বেশ জ্বর। গোটা রাত ঘুমাতে পারিনি। এরপর বেশ কয়েক দিন খারাপই গেল। এরপর দেখেছি খণ্ডিত দেহ। রাজনৈতিক হত্যা। জরুরি বিভাগ। অনেকটাই পাল্টে গেলাম। স্বাভাবিক হতে শুরু করল এসব পরিস্থিতি।
অন্যদের মতো আমিও ঘুরতে পছন্দ করি। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় ঘোরার সুযোগ হয়েছে কাজের জন্য। পাহাড়, সমুদ্র, নদী, চর, বন—কোথাও বাদ পড়েনি। দেশের বাইরেও বহু বার গিয়েছি এনটিভির কারণে।
অনেক সুযোগই হয়তো কাজে লাগাতে পারিনি। এনটিভি কিন্তু জায়গা করে দিয়েছিল। কিছু অসাধারণ মানুষের সাথে কাজ করতে পেরেছি। বন্ধু হয়েছে অনেক। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি সীমাহীন। সব কিছু লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। কিছু লিখতে হলো এনটিভি অনলাইনের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ও বন্ধু ফকরউদ্দীন জুয়েলের কারণে। সব সময় ভালোবাসা থাকবে এনটিভির প্রতি।