সাত খুন
তবুও বাবার জন্য অপেক্ষা!
নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামিদের ২৬ জনকে ফাঁসি এবং অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন আদালত। খুন হওয়া সাতজনের একজন আইনজীবী চন্দন সরকারের ছোট মেয়ে এখনো বাবার অপেক্ষায়। ‘মা, আমি আসছি। তোমাকে কোচিংয়ে নিয়ে যাব।’ মেয়ে সপ্তর্ষিকে মুঠোফোনে শেষ এ কথা বলেছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। এ-লেভেলের শিক্ষার্থী সপ্তর্ষি আজও অপেক্ষায়, বাবা চন্দন সরকার তাকে এসে কোচিংয়ে নিয়ে যাবেন। বাবার অপেক্ষায় থাকা সপ্তর্ষি এখনো শেষ করতে পারেনি এ-লেভেলের পড়াশোনা।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুলসহ পাঁচজনকে অপহরণের দৃশ্য দেখে ফেলায় চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহীমকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায় র্যাবের একটি দল। সেদিন রাতেই অপর পাঁচজনের সঙ্গে তাঁদেরও হত্যা করা হয়। এ ঘটনার প্রায় পৌনে তিন বছর পর গত সোমবার রায় ঘোষণা করা হয়। প্রধান আসামি নূর হোসেন, লে. কর্নেল সাঈদ, মেজর আরিফুল, লে. কমান্ডার রানাসহ মোট ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনসহ ২৬ জনের ফাঁসির রায়ে সন্তুষ্ট চন্দন সরকারের পরিবার। এ রায়ে সত্যের জয় হয়েছে, এমনটা বলছেন তাঁরা। কিন্তু পরিবারের ওই সদস্যের অপূর্ণতা? আজও চন্দন সরকারের মেয়েরা তাদের বাবার পথ চেয়ে আছে। বাবা তাদের জন্য কিছু রেখে যাননি। সে জন্য প্রতিমুহূর্তে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয় তাদের। সংসারে তাদের কোনো ভাই নেই। ছোট বোন ছাড়া অন্য বোনেরা কেবলই পাস করেছে। সংসার চালানো তাদের জন্য অনেক কষ্টকর একটি ব্যাপার আজ। কিন্তু একসময় তাদের কোনো দুঃখ ছিল না। তাদের বাবা সারা জীবন সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেছেন। নিজের কথা চিন্তা করতেন কম। আজ তারা নিতান্ত অসহায় হয়ে বাবার পথ চেয়ে আছে।
অপহরণের দৃশ্য দেখে ফেলেছিলেন, এটাই কি ছিল তাঁর অপরাধ? যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই বেতন-ভাতা ভালো ছিল। তাহলে কিসের জন্য, কয় টাকার জন্য, কিসের অভাবে এতগুলো নিরীহ লোককে খুন করতে হবে? এমন অনেক প্রশ্ন আছে তাঁদের। তারপরও সান্ত্বনা অন্তত বিচারটা পেলেন তাঁরা। এমন অনেক মামলার বিচারই তো হয় না।
চন্দন সরকার লেখক ছিলেন। তিনি সব সময় আত্মকেন্দ্রিক না হওয়ার কথা বলতেন। সবার জন্য হওয়াটা সার্থকতা আছে। সবার জন্য সবাই। এটাতে বেশ জোরালো বিশ্বাস ছিল তাঁর। তা না হলে একজন অপরিচিত মানুষের জন্য কেউ জীবন দান করে, এটা ভাবা যায়? নিজের সন্তানের জন্য করেননি। আত্মীয়স্বজনের জন্যও না। একজন অপরিচিত মানুষ, যাঁকে জীবনে তিনি চিনতেনও না। সেই মানুষ একজন অপরিচিত মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এটা তো কল্পনাই করা যায় না। এটা আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয়। সবাই সবার জন্য কাজ করলে তাহলে কেউ একা হবে না। তাহলে কারো সঙ্গে অন্যায়ও হবে না।
চন্দন সরকারের চার মেয়ে। তিনজনের বিয়ে হয়েছে। এ-লেভেলপড়ুয়া ছোট বোন সপ্তর্ষি সরকার এখনো বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকে। কোনো ভাই না থাকায় এখন ছোট মেয়ে আর মা এক সংসারে। তিন বোন যে যার স্বামীর বাড়িতে থাকে। বাবার শোকে চার মেয়ের মা অর্চনা সরকার ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মেয়েরা তাই চেয়ে আছে বাবার পথ। কবে ফিরবে বাবা? নাকি আদৌ ফিরবে না!
লেখক : প্রতিনিধি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।