নিরাপদ সাংবাদিকতা
বিচারহীনতার সংস্কৃতি শেষ হবে কি?
বহুকাল আগে। এক রাজার খায়েশ হলো, দুধভর্তি পুকুরে গোসল করবেন। হুকুম হলো, রাজ্যের সবচেয়ে বড় পুকুর খননের। রাজ্যজুড়ে এলান করা হলো, অগ্রহায়ণের ১ তারিখ প্রজারা এক বাটি করে দুধ ঢালবেন সেই পুকুরে। সেই থেকেই ঘুম হয় না গরিব কৃষক গনি মিয়ার। ভাবতে থাকে, কীভাবে পার পাওয়া যায় দুধ না ঢেলে। বউ বুদ্ধি দিল, সবাই তো নিয়ে যাবেই, তুমি না হয় বাটিতে করে পানি নিয়ে যেও। এত দুধের মধ্যে তোমার পানি ধরা যাবে না। দুরুদুরু বুকে পুকুর ভর্তির দিন সকালে বাটিতে পানি নিয়ে হাজির হলো গনি মিয়া। ঢেলে দিলেই কেল্লা ফতে। ঢোলের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে সবাই যার যার বাটি উপুড় করে দিল। গনি অবাক, পুরো পুকুরজুড়েই পানি।
পুরোনো গল্প লেখার একটা কারণ অবশ্যই আছে। আমরা মানে, সাংবাদিকরা এখন প্রত্যেকেই সেই গল্পের গনি মিয়া। নিজে আগে বাঁচি, সবাই তো তার কাজ করবেই।
আবদুল হাকিম শিমুল কি এই গল্পটি পড়েছিলেন? পড়লে নিশ্চয়ই কর্মস্থলকে সঠিক ও নির্ভুল তথ্য দিতে সংঘর্ষের সময় উপস্থিত থাকতেন না। অনেক সাংবাদিকই তো নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, বাকিরা তো আছেনই, আমি না গেলেও হবে। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরদিন যখন মারা গেলেন ঢাকায় আসার পথে, তখন কি এ প্রশ্ন জাগে না ঘটনার দিনই কেন তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেনি শিমুলের প্রিয় কর্মস্থল?
শিমুল ভাইয়ের মৃত্যুর পর ফেসবুকে গরম স্ট্যাটাস দিয়েছি আমরা অনেকেই। প্রথম আলোতে কর্মরত এক সহকর্মী লিখেছেন, ‘আবদুল হাকিম শিমুল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে তাঁর চিকিৎসার জন্য সমকাল কি আদৌ কোনো উদ্যোগ নিয়েছিল? শিমুল কর্তব্য পালন করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর কর্মস্থল সমকালে এত বাঘা বাঘা রিপোর্টার, সাংবাদিক নেতা! তাঁরা কেউ পারলেন না তাঁদের সহকর্মীকে উড়িয়ে ঢাকায় একটা ভালো হাসপাতালে নিয়ে আসতে!
সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা, সেটা সকলেই জানেন। কিন্তু শিমুলের মৃত্যুটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানের অবহেলা আর নিস্পৃহতাগুলোকে। আমরা কি সেই বার্তাটা বুঝতে পেরেছি?’
আবদুল হাকিম শিমুলের হত্যা নিয়ে তরুণ অনেক সংবাদকর্মীই বলছেন আন্দোলনে যাওয়ার, প্রতিশোধ নেওয়ার। এরই মাঝে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশ্বাস দিয়েছেন, জড়িতদের শাস্তি হবেই। কিন্তু সেই শাস্তির নমুনা কি পৌর মেয়র হালিমুল হক পলাতক হওয়ার খবরে?
উপজেলা প্রতিনিধি খুনের ঘটনায় বিচার হলে কিন্তু একটু অবাকই হবেন মানিক সাহা, হুমায়ুন কবীর বালু, সাগর-রুনি পরিবারের সদস্যরা। দিনের পর দিন আন্দোলন হয়েছে। পত্রিকার পাতাজুড়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু বিচার কি হয়েছে সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলোর? তবে কাজের কাজ কিন্তু হয়েছে, অনেক বড় সাংবাদিক নেতাকে দেখেছি আরো বড় পদে যেতে। নতুন গাড়ি, ফ্ল্যাটে উঠতে। এবারও হয়তো শিমুল ভাইয়ের হত্যা নিয়ে আন্দোলন হবে। কথার ফুলঝুরিতে আশা বাধবেন তাঁর স্ত্রী। কিন্তু পলাতক মেয়র কি সহসাই ফিরে আসবেন? একত্র হয়ে খণ্ড খণ্ড হওয়া সাংবাদিক সংগঠন জোরালো দাবি তুলতে পারবে প্রশাসনের কাছে?
আবার দুধভর্তি পুকুরের গল্পে আসি। কোনো সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনার পর অনেককে বলতে শুনি, কোনো না কোনো ঝামেলা তো ছিলই, শুধু শুধু তো হয়নি। তখন তাঁদের বলতে ইচ্ছে হয়, আপনি যদি থাকতেন তখন তো এ কথা বলতেন না। নিজে বা প্রতিষ্ঠানের কেউ আহত বা নিহত না হলে সহজে প্রতিবাদ করে না আমাদের সাংবাদিকরা। এ কথা চিরন্তন সত্য।
গত ২৬ জানুয়ারি সুন্দরবন বাঁচাও হরতালে সাংবাদিক নির্যাতনের সময় ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলাম। কোনো ধরনের কারণই ছিল না সেখানে। পুলিশের অতি উৎসাহী কিছু সদস্য বেদম মারধর করে এটিএন নিউজের রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানকে। প্রতিবাদ শুরু করার পর আশ্বাস মেলে বিচারের। কিন্তু নয়জন দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও এখনো পাওয়া যায়নি শাস্তির কোনো ঘোষণা। দেখি, এ দাবি নিয়ে আবার নতুন কোন পদ বাগাতে সফল হন কি না কেউ কেউ?
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।