সাদাসিধে কথা
আমস্টারডাম
১.
আমস্টারডাম শহরে প্রথম দিন ভোরবেলা বের হয়েছি, আমাদের সঙ্গে আমার ছেলে। ঝলমলে একটা শহরে হাসিখুশি, সুখী মানুষের ভিড়, তার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে আমার ছেলে আমাকে খুব মূল্যবান একটা তথ্য দিল। বলল, ‘যখন কফি খাওয়ার ইচ্ছে করবে, খবরদার কফি শপে ঢুকবে না।’
আমি ও আমার স্ত্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
আমার ছেলে বলল, ‘কারণ কফি শপ হচ্ছে গাঁজা খাওয়ার দোকান। কফি খেতে হলে যাবে ক্যাফেতে।’
আমার ছেলে তার পুরোনো মডেলের বাবা-মাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে কি না, সেটা সঙ্গে সঙ্গেই পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ হলো। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় একটু পরে পরেই কফি শপ, সেই কফি শপে কেউ কফি খাচ্ছে না। ঢুলু ঢুলু চোখে গাঁজা টানছে। অতি বিচিত্র একটি দৃশ্য!
আমস্টারডামে অবশ্য এটা মোটেও বিচিত্র নয়, এখানে গাঁজা খাওয়া আইনসংগত ব্যাপার। যারাই দেশ-বিদেশ, বিশেষ করে ইউরোপের খোঁজখবর রাখেন, তারা সবাই জানেন, হল্যান্ডে টিউলিপ ফুলের ছড়াছড়ি। ইউরোপের বড় শিল্পীরা প্রায় সবাই উইন্ডমিলের সামনে বিশাল বিশাল টিউলিপ বাগানের ছবি এঁকেছেন। কাজেই আমস্টারডামে ফুলের বিশাল নার্সারি থাকবে, সেটি মোটেও অবাক হবার কিছু নয়। কিন্তু সেই অপূর্ব নার্সারির অসংখ্য ফুলের গাছ, গাছের চারা, ফুলের বীজের মাঝে বড় একটা জায়গা দখল করে আছে গাঁজার গাছ! সেখানে নানা ধরনের গাঁজার চারা বিক্রি হচ্ছে এবং মানুষজন আগ্রহ নিয়ে সেগুলো কিনছে!
আমস্টারডামের মতো এত সুন্দর একটা শহরের বর্ণনা দেবার সময় প্রথমেই গাঁজার গল্প দিয়ে শুরু করা মনে হয় ঠিক হলো না। কিন্তু কেউ যেন মনে না করে, এই পুরো শহরটিতে অসংখ্য গাঁজাখোর মানুষ সারাক্ষণ ঢুলু ঢুলু লাল চোখে বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করছে। এটি খুবই আনন্দমুখর নিরাপদ একটি শহর। আমি ও আমার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে সিনেমা দেখে গভীর রাতে নিশাচর শিল্পীর সুমধুর ট্রাম্পেট শুনতে শুনতে বাসায় ফিরে এসেছি। একবারও মনে হয়নি পথেঘাটে কোথাও নিরাপত্তার কোনো অভাব আছে!
আমস্টারডামে শুধু যে প্রকাশ্যে গাঁজা বিক্রি হয় তা-ই নয়, গাঁজা ছাড়াও আরো নানা ধরনের নেশার জিনিসপত্র খোলা দোকানে কেনা যায়। খরিদ্দার অবশ্য বেশিরভাগই পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আসা ট্যুরিস্ট! আমস্টারডামের দেখাদেখি আমেরিকার অনেক শহরেও আজকাল গাঁজা বিক্রি করা আইনসিদ্ধ করে দিয়েছে। আমি যে শহরে আমার পিএইচডি করেছি, সেই সিয়াটল শহরটি এরকম একটি শহর। তবে আমি একটি হিসাব মেলাতে পারি না, এখন আমেরিকার নানা শহরে এই মাদকগুলো আইনসিদ্ধভাবে কেনা যায়। কিন্তু আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগে এগুলোসহ কাউকে ধরা হলে তাকে সারা জীবনের জন্য জেলে বন্দি করে রাখা হতো। নিশ্চয়ই এরকম অসংখ্য মানুষ এখনো জেলেজীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। রোনাল্ড রিগানের আমলে মাদকমুক্ত সমাজ তৈরি করার নামে বেছে বেছে কালো মানুষদের এই আইনগুলোর আওতায় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যারা পৃথিবীর খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো কী অবলীলায় পথেঘাটে কালো মানুষদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়!
২.
বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে একেকজনের একেক ধরনের শখ থাকে- আমার সেরকম কোনো শখ এখন আর নেই। শুধু একটি শখ এখনো রয়ে গেছে, সেটি হচ্ছে আর্ট মিউজিয়াম দেখা। আমস্টারডামে এসে আবিষ্কার করলাম এখানে খুব সুন্দর সুন্দর আর্ট মিউজিয়াম আছে। ছোট বাচ্চারা যেভাবে তাদের পছন্দের চকলেট বা আইসক্রিম বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে একটু একটু করে খায় আমিও প্রায় সেভাবে এই মিউজিয়ামগুলো দেখেছি।
প্রথমে দেখতে গিয়েছি মডার্ন আর্টের মিউজিয়াম। গিয়ে দেখি, আমাদের কী সৌভাগ্য, হেনরি মাতিসের একটা বিশেষ প্রদর্শনী চলছে। সারা পৃথিবী থেকে হেনরি মাতিসের পেইন্টিং এনে জড়ো করা হয়েছে। হেনরি মাতিস শেষ বয়সে রঙিন কাগজ কেটে কেটে আঠা দিয়ে লাগিয়ে লাগিয়ে অনেক ছবি তৈরি করেছেন। উজ্জ্বল রঙের সেই ছবিগুলোর ছাপ অনেকবার বইপত্র ইন্টারনেটে দেখেছি। আমাদের দেশে কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরি করতে প্রচ্ছদশিল্পীরা উদারভাবে সেই ছবিগুলো ব্যবহার করেন! সেই বিখ্যাত ছবিগুলোর অনেকগুলো এখানে ছিল, দেখে অন্য এক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে।
যেহেতু মিউজিয়ামটি মডার্ন আর্টের, কাজেই সেখানে অতি বিচিত্র কিছু শিল্পকর্ম ছিল। যেমন একটা ছোট টেবিলে একটা অত্যন্ত ময়লা চাদর ভাঁজ করে রাখা। দেয়ালে অনেক বড় করে এই শিল্পকর্মটি ব্যাখ্যা করা আছে। এটা দেখে তুচ্ছ একটা ময়লা চাদর মনে হলেও শিল্পী যে অসংখ্য ময়লা চাদর দেখে দেখে শেষ পর্যন্ত এটা বেছে নিয়েছেন এবং এর ভাঁজ করার মাঝেও যে অন্য এক ধরনের শিল্প লুকিয়ে আছে সেটা গুরুত্ব দিয়ে লেখা আছে। তবে আশার কথা, এই ধরনের শিল্পকর্মের গ্যালারিগুলো একেবারে ফাঁকা। কেউ সেগুলো দেখতে যান না! সাধারণ দর্শকদের বোকা বানানো মোটেই সহজ নয়। তাদের কাছে যেটা ভালো লাগে তারা সেটা ভিড় করে দেখে, মন দিয়ে দেখে! মাঝে মাঝেই আমি পরিচিতদের একটা পেইন্টিং দেখে বলতে শুনি, ‘এটা কী ছবি? কিছুই তো বুঝি না!’
তাদের জানিয়ে রাখি, যারা ছবি বোঝার চেষ্টা করে, তারা ছবি উপভোগ করতে পারে না। কাজেই কেউ যেন ছবি বোঝার চেষ্টা না করে, ভালো লাগলে প্রাণভরে উপভোগ করুক, ভালো না লাগলে পাশের পেইন্টিংয়ে চলে যাক! ছবিটা বোঝাই যদি গুরুত্বপূর্ণ হতো, তাহলে ফটোগ্রাফি আবিষ্কার হওয়ার পর পৃথিবী থেকে ছবি আঁকার ব্যাপারটা উঠে যেত!
মডার্ন আর্টের মিউজিয়াম দেখার কয়েক দিন পরে গিয়েছি জগদ্বিখ্যাত ভ্যান গয়ের মিউজিয়াম দেখতে ( ভ্যান গয়ের নামের প্রকৃত উচ্চারণ বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখা সম্ভব না- আমি তার চেষ্টাও করছি না!) যারা পৃথিবীর বড় বড় শিল্পীর কথা পড়েছে তারা সবাই ভ্যান গয়ের নাম শুনেছে। আমিও শুনেছি এবং পৃথিবীর অনেক বড় বড় মিউজিয়ামে ভ্যান গয়ের পেইন্টিংও দেখেছি। তাঁর ছবিগুলো দেখে দেখে মোটামুটিভাবে তাঁর ছবি আঁকার ধরনের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। ওই মিউজিয়ামে এসে অন্য ধরনের ছবিগুলো দেখে আমার নতুন এক ধরনের অভিজ্ঞতা হলো। এই জগদ্বিখ্যাত শিল্পীর কিন্তু শিল্পী হওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, সাতাশ বছর বয়সে হঠাৎ করে ঠিক করলেন ছবি আঁকবেন। প্রথম কয়েক বছর ছবি আঁকা শিখলেন, তারপর আঁকতে শুরু করলেন। বছর দশেক ছবি আঁকার পর এক ধরনের মানসিক সমস্যা হতে শুরু করল। তখন একদিন গুলি করে আত্মহত্যা করে নিজের জীবন শেষ করে দিলেন। এখন তার একেকটা ছবি ষাট-পঁয়ষট্টি মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তার একটি ছবিও বিক্রি হয়েছে বলে জানা নেই। তার অর্থকষ্টের নমুনাও এই মিউজিয়ামে আছে।
নতুন ক্যানভাস কেনার পয়সা নেই বলে একই ক্যানভাসের দুই পাশে দুটি ভিন্ন ছবি এঁকে রেখেছেন। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষকে দুই পাশের দুটি ভিন্ন ছবি দর্শকদের দেখানোর জন্য অনেক রকম কায়দাকানুন করতে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মডেলকে দেওয়ার মতো টাকাপয়সা নেই বলে বারবার নিজের ছবি এঁকেছেন। আমরা যারা ভ্যান গ সম্পর্কে একটু আধটু খোঁজখবর রাখি, তারা সবাই জানি, তিনি নিজের কান কেটে ফেলেছিলেন। কেন কেটেছিলেন সেটা আমার কাছে একটা রহস্যের মতো ছিল। কোনো একজন বান্ধবীকে সেই কাটা কান উপহার দিয়ে এসেছিলেন সেরকম শুনেছিলাম। এই মিউজিয়ামে এসে প্রকৃত ঘটনা জানতে পারলাম। পল গগাঁ নামে আরেকজন বিখ্যাত শিল্পী একবার তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। দুজনে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সময় কাটানোর কথা ছিল কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি দুজনের ভেতর ঝগড়া লেগে গেল এবং সেই ঝগড়া এমন পর্যায়ে চলে গেল যে ভ্যান গ রেগেমেগে এক সময় তার কানের এক টুকরো কেটে ফেললেন! কান কাটার পর তার অনেকগুলো আত্ম প্রতিকৃতিতে দেখা যায় তার কাটা কান ব্যান্ডেজ করে রাখা!
ভ্যান গ বেশিরভাগ সময় খুবই সাধারণ চাষি-শ্রমিকের ছবি এঁকেছেন। তাদের জীবনটা ভ্যান গয়ের কাছে খুবই আন্তরিক এবং খাঁটি মনে হতো। আমার এবার একই সঙ্গে মাতিস আর ভ্যান গয়ের ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে। মাতিসের জীবনটি মনে হয় ছিল ভ্যান গয়ের উল্টো। তার একজন সহকারী মেয়ে একবার ছুটিতে গ্রামে সময় কাটিয়ে এসেছে, রোদে পুড়ে গায়ের রং তামাটে হয়ে এসেছে, তাকে দেখে মাতিস খুবই বিরক্ত হলেন। কারণ রোদে পোড়া মেয়েটিকে তখন ‘চাষা’ মেয়ের মতো লাগছিল! একজন ছবি আঁকার জন্য ‘চাষা’ মেয়েদের খুঁজে বেরিয়েছেন, অন্যজন শুধু দেখতে চাষা মেয়েদের মতো লাগছে বলে বিরক্ত হয়েছেন। দুজন শিল্পীর মানসিকতায় কত পার্থক্য।
আমস্টারডামের সবচেয়ে বড় আর্ট মিউজিয়াম হচ্ছে রাইকস মিউজিয়াম, এটি দেখেছি সবার শেষে। মিউজিয়ামে ছোট ছোট গ্যালারি থাকে- আমার সব সময়ই মনে হয় ভুলে বুঝি কোনো একটা গ্যালারি না দেখে চলে আসব। সেই গ্যালারিতেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছবিটা না দেখা থেকে যাবে! সেটা যেন না হয়, তার চেষ্টা করতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সবকিছুই বারবার দেখা হয়ে যায়। এই মিউজিয়ামের শিল্পীরা তুলনামূলকভাবে একটু আগের। আমার দুজন প্রিয় শিল্পী র্যা মব্রন্ট এবং ভারমিয়ারের অনেক ছবি এই মিউজিয়ামে আছে। যখন আমি ঢাকা কলেজে পড়তাম তখন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে এসে বই পড়তাম। পাবলিক লাইব্রেরির একটা কাচে ঢাকা শেলফে র্যা মব্রান্টের আঁকা ছবির একটা খুব সুন্দর বই ছিল। আমি পাবলিক লাইব্রেরি এলেই সেই বইটি বের করে তার আঁকা ছবিগুলো দেখতাম। ছবিগুলো আমার স্মৃতির মাঝে গাঁথা হয়ে আছে। এতোদিন পর রাইকস মিউজিয়ামে সেই ছবিগুলো দেখে আমার অন্য এক ধরনের আনন্দ হয়েছে।
রাইকস মিউজিয়ামের সবচেয়ে বড় ছবিটি র্যা মব্রান্টের আঁকা। ছবির দুই পাশে দুজন প্রহরী সব সময় ছবিটি পাহারা দিচ্ছে। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, এই ছবিটি আরো বড় ছিল। কোনো একটা দেয়ালে ফিট করার জন্য ছবির একটা বড় অংশ কেটে ফেলে দিয়ে ছবিটি ছোট করা হয়েছে! কাটা অংশটি রক্ষা করা হয়নি, কিন্তু পুরো ছবিটা দেখতে কেমন ছিল তার একটা ছোট ছবি দর্শকের জন্য রাখা আছে। দর্শকেরা সেই ছবি দেখে এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলে!
পৃথিবীর সব বড় বড় শহরের আকর্ষণ হচ্ছে তার আর্ট মিউজিয়াম। ঢাকা শহর থেকে বড় শহর পৃথিবীতে আর কয়টা আছে? তাহলে আমাদের ঢাকা শহরে কেন অসাধারণ একটা আর্ট মিউজিয়াম তৈরি করতে পারি না? ইউরোপিয়ান ছবির একটা ধরন আছে, আমরা সেগুলো দেখে আহা-উহু করি, কিন্তু আমাদের দেশের ছবিরও যে একটা নিজস্ব ধরন আছে সেগুলো নিয়েও যে গর্ব করা যায়, সেটা কেন জানি মনে রাখি না।
যা-ই হোক, আমস্টারডামের আর্ট মিউজিয়ামে অসংখ্য ছবি উপভোগ করতে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় দেখে এসেছি। তার বর্ণনা না দিলে মিউজিয়াম দেখার অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ভ্যান গ মিউজিয়ামে ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা খোলা জায়গায় উপস্থিত হয়েছি যেখানে অনেকগুলো কফিনের মতো বাক্স দাঁড় করিয়ে রাখা আছে এবং মানুষজন সেখানে ঢুকে তার দরজা বন্ধ করে বসে আছে। বিষয়টা কী, বোঝার জন্য বাক্সগুলোর বর্ণনা পড়ে চমৎকৃত হলাম। মিউজিয়ামে ছবি দেখতে দেখতে যদি মানুষজন ক্লান্ত হয়ে যায়, তাহলে এই কফিনের মতো বাক্সে ঢুকে দরজা বন্ধ করে অন্ধকার করে কিছুক্ষণ বসে থাকে এবং তারপর ছবি দেখার ক্লান্তি থেকে মুক্ত হয়ে আবার নতুন উদ্যমে ছবি দেখা শুরু করে। মানুষজন খুবই গুরুত্ব নিয়ে এভাবে নিজেদের ছবি দেখার ক্লান্তি থেকে মুক্ত করছিল; কিন্তু আমার কাছে পুরো প্রক্রিয়াটিকে একটা কৌতুক থেকে বেশি কিছু মনে হয়নি!
৩.
আমস্টারডাম শহরটি ছবির মতো সুন্দর, পুরো শহরটি অর্ধবৃত্তাকার খাল এবং কেন্দ্রমুখী রাস্তা দিয়ে নিখুঁত পরিকল্পনা করে তৈরি। শহরে প্রাচীন ইউরোপিয়ান বিল্ডিংগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। মানুষগুলো দীর্ঘদেহী, সারা শহরে ফুলের ছড়াছড়ি, কিন্তু আমাকে মুগ্ধ করেছে অন্য একটি বিষয়। সেটি হচ্ছে এই শহরের মানুষের যাতায়াত করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে বাইসাইকেল। ছোট বাচ্চা থেকে আশি বছরের বুড়োবুড়ি সবাই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে-আসছে। শহরের প্রতিটি রাস্তার পাশে হাঁটার জন্য ফুটপাত, তার পাশে সাইকেলের জন্য আলাদা রাস্তা এবং সেই রাস্তা ধরে শহরের সব মানুষ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে! যেহেতু সবাই জন্ম থেকে সাইকেল চালায়, তাই দেখে মনে হয়, সবাই বুঝি সাইকেল চালানোয় এক্সপার্ট। এক হাতে নিজের সাইকেল ধরে অন্য হাতে আরেকটি সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কিংবা এক হাতে নিজের সাইকেল এবং অন্য হাতে চাকা লাগানো সুটকেস টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিংবা সাইকেলের হ্যান্ডেল ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে স্মার্টফোনে ‘টেক্সটিং’ করতে করতে যাচ্ছে কিংবা হ্যান্ডেল ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে নাচের মুদ্রা প্র্যাকটিস করতে করতে যাচ্ছে- আমস্টারডাম শহরের সাইকেলচালকদের জন্য এগুলো খুবই নিয়মিত কিছু দৃশ্য।
যেহেতু এই শহরের সবকিছুই সাইকেল চালিয়ে করা হয়, তাই এখানে সাইকেলের নানা ধরনের বিবর্তন ঘটেছে। সবচেয়ে সুন্দরটি হচ্ছে ছোট শিশুদের নিয়ে সাইকেল চালানোর বিষয়টি। সাইকেলের সামনে ছোট বাচ্চাদের বসার মতো একটি ওয়াগন এবং মায়েরা তাদের বাচ্চাদের সেখানে আরামে এবং নিরাপদে বসিয়ে সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমস্টারডামে সাইকেলের এই বিশাল দজ্ঞযজ্ঞ দেখে আমাদেরও সাইকেল চালানোর শখ হলো। একদিন সাইকেল ভাড়া করে নিয়ে আমি, আমার স্ত্রী এবং পুত্র ও কন্যা মিলে একটা পার্কে সাইকেল চালিয়ে বেড়ালাম। পুত্র ও কন্যার আলাদা সাইকেল, আমার এবং আমার স্ত্রীর জন্য একটি ট্যানডেম বাই সাইকেল! একই সাইকেলে দুজন, একজন সামনে এবং একজন পেছনে, দুজনে মিলে সেই সাইকেল চালানো হয়- ভারি মজার ব্যাপার!
আমস্টারডামে সাইকেলের এই বিশাল আয়োজন দেখে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি যে, আমাদের দেশের ট্রাফিক জ্যাম থেকে শুরু করে যাতায়াতের সব সমস্যা এই সাইকেল দিয়ে সমাধান করে ফেলা সম্ভব। সরকার থেকে যদি ঢাকা শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার পাশে পাশে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটুখানি জায়গা আলাদা করে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলেই দেশে একটা বিপ্লব হয়ে যাবে। আমি লক্ষ করেছি, আমাদের তরুণেরা আজকাল অনেক বেশি সাইকেলে চড়ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র ও ছাত্রীরা সমানভাবে সাইকেল চালিয়ে আসছে- এর থেকে সুন্দর বিষয় আর কী হতে পারে? সাইকেলকে জনপ্রিয় করার জন্য বাংলাদেশে নিশ্চয়ই অনেক সংগঠন দাঁড়িয়ে গেছে। এবার আমস্টারডাম থেকে ঘুরে যাওয়ার পর আমি ঠিক করেছি, এই সংগঠনগুলো খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে একটু কাজ করতে হবে।
৪.
আমার এ লেখাটি পড়ে সবার নিশ্চয়ই ধারণা হতে পারে ইউরোপের চমৎকার একটি শহর নিয়ে আমার ভেতরে বুঝি শুধু এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময়! এটি পুরোপুরি সত্যি নয়। আমি যখন চারদিকে তাকাই এই ইউরোপীয় শহরের সভ্যতার ইতিহাস কিংবা ঐশ্বর্য দেখি তখন সব সময়ই মনে পড়ে, এই দেশগুলো আমাদের দেশগুলোকে কলোনি করে কয়েক শ বছর আগে আমাদের সব সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের সম্পদ গড়ে তুলেছে! এখন আমাদের দেশগুলোর জন্য তাদের ভেতরে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন অবহেলা এবং তাচ্ছিল্য। আমস্টারডামে থাকা অবস্থাতেই খোঁজ পেয়েছি, আমার পরিচিত একজন এখানে কোনো একটা প্রশিক্ষণে আসার চেষ্টা করেছিল শেষ পর্যন্ত ভিসা পায়নি বলে আসতে পারেনি।
আমি ও আমার স্ত্রী যেদিন আমস্টারডামে প্লেন থেকে নেমেছি তখন বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে একটি কোর্স পড়াতে একই প্লেনে এসেছেন। যখন ইমিগ্রেশনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তখন তিনি আমার পাশের কাউন্টারে দাঁড়িয়েছেন। আমার পাসপোর্টটিতে চোখ বুলিয়ে সেটি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে কিন্তু আমি লক্ষ করলাম, পাশের কাউন্টারের মানুষটি চোখে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস লাগিয়ে বাংলাদেশের অধ্যাপকের ভিসা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছে। এই দেশের প্রখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে তাদের ছাত্রছাত্রীদের একটি কোর্স পড়ানোর জন্য আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে যদি সন্দেহ করা হয়, তিনি পাসপোর্টে একটা জাল ভিসা লাগিয়ে এ দেশে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তাহলে সেই অপমান আমরা কেমন করে সহ্য করব?
আমি স্বপ্ন দেখি, ভবিষ্যতে কোনো একদিন আমার দেশ পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন আমাদের এই সবুজ পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে বিদেশ যাবে, আমাদের মতো তাদের এই অপমান আর সহ্য করতে হবে না!
১৫.৬.১৫