রাজকাহিনী বিতর্ক
জয়ার সঙ্গে সানির তুলনা ও গণমাধ্যমের দায়
চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নির্মাতা আলফ্রেড হিচকক প্রায়ই পিলে চমকে দেওয়া কথাবার্তা বলতেন। একবার শিল্পীদের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বলছি না যে তারা (অভিনয়শিল্পী) ঠিক গবাদি পশু, তবে তাঁদের গবাদি পশু হিসেবেই পরিচালনা করা উচিত!’ হলিউডের ক্ল্যাসিক যুগ থেকে সময় বদলেছে অনেক, তবে শিল্পীর ওপর পরিচালকের প্রভাব বা খবরদারি কিন্তু এখনো কমেনি। অনেকাংশে বেড়েছে বলা যেতে পারে। কারণ একটি সিনেমার সত্তাকে সবচেয়ে বেশি ধারণ করেন অবশ্যই ছবির পরিচালক। শিল্পী সেখানে দিনশেষে কেবলই নিয়ামক বা উপলক্ষ মাত্র।
নামিদামি তারকারা এখনো সিনেমার সেটে পরিচালকের ধমক খান, শাস্তি পান, এমনকি সেসব অভিজ্ঞতার কথা নির্দ্বিধায় বলেনও অনেক সময়। কারণ এ বিষয়টা তাঁরা বা মোটামুটি বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রেই জানেন, রুপালি পর্দায় শিল্পীরা সে অনুযায়ীই অভিনয়, আচরণ বা পারফর্ম করেন যেমনটা তাঁদের ওপর নির্দেশনা থাকে। পুরো ছবিতে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ পর্যন্ত, সবকিছুতেই তাঁরা কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রিত, যার প্রধান নিয়ন্ত্রক স্বয়ং পরিচালক।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অত্যুৎসাহী এবং উচ্চমাত্রায় সচেতন এক জনগোষ্ঠী সব সময়ই পাওয়া যায়, যারা সহজাত বিষয়টিকে বিকৃতির পর্যায়ে নিয়ে যান, পাশাপাশি কল্পনাশক্তির জোরে দেন বিচিত্র সব যুক্তি। তাদের এইসব হাইপোথিসিস যদি তাদের সেই নির্দিষ্ট ঘরানার মধ্যেই সব সময় আবদ্ধ থাকত, তবে বিশেষ চিন্তার বিষয় ছিল না। কিন্তু এই ফেসবুক-টুইটার-ইউটিউব কিংবা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অগণিত অনলাইন সংবাদমাধ্যমের যুগে তো ঘরের কথাই ঘরে থাকে না। সেখানে সেলিব্রিটিদের এমনই দুর্দশা হয়, তার উদাহরণ আমরা এখন প্রায় প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি। যেমনটা ঘটল জয়া আহসানের ক্ষেত্রে। অভিনয়ের যোগ্যতায় দেশের ময়দান পেরিয়ে তিনি ভারতেও কাজ করছেন। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের আলোচিত মেগা স্টারকাস্টিং ছবি ‘রাজকাহিনী’তে অভিনয় করেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। বিপত্তি সেখানেই।
সৃজিত কলকাতার নতুন ঘরানার নির্মাতাদের মধ্যে এরই মধ্যে পথিকৃৎ হয়ে উঠতে পেরেছেন বলা যায়। ‘অটোগ্রাফ’, ‘বাইশে শ্রাবণ’ ‘হেমলক সোসাইটি’, ‘চতুষ্কোণ’-এর মতো ছবিগুলো যেমন দর্শক-সমালোচকের প্রশংসা কুড়িয়েছে; তেমনি ব্যবসাও করেছে ভালো। ‘রাজকাহিনী’ সৃজিতের বড় প্রস্তুতি নিয়ে গড়া বড় ক্যানভাসের ছবি। দেশভাগের কাহিনী নিয়ে নির্মিত এ ছবিতে আয়োজন, কাহিনী বিন্যাস বা কাস্টিং; কোনোকিছুতেই কার্পণ্য করেননি একচুল। এ ছবির প্রধান নারী চরিত্ররা একটি বিশেষ পেশার অন্তর্গত, যাকে আমরা কালে-অকালে ‘পতিতা’, ‘বেশ্যা’, ‘দেহাপসারিণী’ তথা বহুবিধ পরিচয়ে সম্বোধন করে থাকি।
ছবির কাহিনীতে দেখা যায় ঋতুপর্ণা, পার্নো, রিধিমা, সোহিনীর মতো জয়া আহসানও অভিনয় করেছেন পতিতার চরিত্রে। জয়ার চরিত্রের নাম রুবিনা। রুবিনা নামসর্বস্ব নয়, বেশ মজবুত একটি চরিত্র। ছবির এক দৃশ্যে সহশিল্পীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অভিনয় করেছেন তিনি, সঙ্গে ছিল কিছু সংলাপ। নারীদেহের অঙ্গ নিয়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সেই সংলাপে, জয়াকেও সেভাবেই দেখা গেছে যেমনটা সেই পরিস্থিতি এবং সংলাপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পরিচালকের নির্দেশনা এবং চিত্রনাট্যের প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি পারফর্ম করেছেন, ব্যস এই তো!
বলা ভালো, উল্লিখিত ‘সদা অত্যুৎসাহী এবং উচ্চমাত্রায় সচেতন এক জনগোষ্ঠী’ কিন্তু সবখানেই ছড়িয়ে রয়েছেন, বিশেষ করে ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। কাজেই তাঁরা দায়িত্ব নিয়ে একটি কাজ করলেন- ওই দৃশ্যটুকু কায়দা করে কেটে নিলেন, তারপর ‘দেখুন জয়া আহসানের হট ভিডিও’ বা আরো অশ্রাব্য-অকথ্য শিরোনাম যুক্ত করে ভিডিওটি ছড়িয়ে দিলেন ইউটিউব-ফেসবুকে। ব্যাপারখানা এমন হয়ে দাঁড়াল, জয়া আহসানের বুঝি কোনো বড় রকমের স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়েছে! আর ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো তো এমন মওকার জন্য মুখিয়ে থাকে সব সময়। তারাও গল্প জুড়ে দিল, ‘দেখুন জয়া আহসানের অমুক তমুক ইত্যাদি (ভিডিওসহ)!
এখানে সবচেয়ে হতাশ করা কাজটি করল ‘আনন্দবাজার’ নামক ভারতের একটি প্রখ্যাত এবং প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম। সংবাদমাধ্যমের লেখা কেমন হওয়া উচিত, তার নমুনায় এ দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ এখনো আনন্দবাজারের উদাহরণ টানেন। সেই ‘অগ্রজ’, ‘দায়িত্বশীল’ গণমাধ্যম আনন্দবাজারের খবরের শিরোনামে উঠে এলো জয়ার সঙ্গে সানি লিওনের তুলনা। ‘ভিডিওসহ’ কর্মকাণ্ডে কম গেল না ‘এবেলা’র মতো আরো অনেক অনেক সংবাদমাধ্যমও। আনন্দবাজারের বৈঠকি চালের ফাংকি সাহিত্য বা শব্দ নিয়ে খেলাধুলা করার তরিকা সবারই জানা। তবে তাতে বৈচিত্র্যের মাত্রায় এতটাই ঘাটতি বা অসারতা তৈরি হয় যে, পার্শ্ববর্তী দেশের একজন সু-অভিনেত্রীকে নিজেদের দেশের একজন প্রশংসিত পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করার জন্য সানি লিওনের সঙ্গে তুলনা করা হয়, এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। এটি কি মেধাগত ঘাটতি, নিম্ন এবং বাজারি-সস্তা মনোবৃত্তি নাকি ইচ্ছাকৃত অপমান; সেটা বোধগম্য নয়। এর যে কোনোটিই হতে পারে, আবার সবগুলোই হতে পারে। কলকাতার তথা পুরো ভারতে এখন ‘এ’ রেটিং বা ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ ট্যাগলাইনে মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। প্রসঙ্গত বলা উচিত, ভারতে কিন্তু ‘বি’ গ্রেডের ‘মসলাদার’ ছবির ইন্ডাস্ট্রিও কম বড় নয়। সেই দেশের এত বড় একটি গণমাধ্যম যদি একটি ছবির দৃশ্যে প্রাসঙ্গিকভাবে অভিনেত্রী শরীরের কোনো অংশ প্রদর্শন বা সংলাপের কারণে তাঁকে কোনো পর্নোস্টারের (পড়ুন সাবেক) সঙ্গে তুলনা করে বসে, তাতে হতাশ হতে হয়।
আরো সোজাসাপ্টাভাবে বলা যাক। কলকাতার ছবি এখন বেশ সাহসী। কমার্শিয়াল মেইনস্ট্রিম বা একটু অফবিট- সব ঘরানার ছবিতেই চুম্বন, ঘনিষ্ঠ বা শয্যাদৃশ্য অথবা চড়া-কড়া খিস্তি (পড়ুন অশ্রাব্য গালিগালাজ) ব্যবহার করা হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। জয়া আহসান ‘রাজকাহিনী’র সেই দৃশ্যে অভিনয় করে ‘যতটুকু অপরাধ’ করেছেন, কলকাতার মূলধারার ছবির অজস্র প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী তার চেয়ে ‘বহুগুণে বেশি অপরাধ’ করেছেন- এ কথা বাজি ধরে বলা যায়। কোথায় তাদেরকে তো ‘সানি লিওন’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়নি! সানি লিওনকে অপমান করার সুযোগ কার্যত নেই, কারণ তিনি কোনো অপরাধও করছেন না, জোর করে কাউকে নিজের পর্নো ক্যারিয়ারের ছবিও দেখাচ্ছেন না- সবচেয়ে বড় কথা, তিনি বলিউডে থিতু হতে এসেছেন তার আগের ক্যারিয়ারে ইস্তফা দিয়ে। কোনো অবস্থাতেই সানি লিওনের সঙ্গে জয়া আহসানকে মেলানো যায় না। কাজেই এই ‘সৃজনশীলতার’ দায়ভার আনন্দবাজার কীভাবে নেবে, সেটা তাদের ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। আর একটি প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম হিসেবে তারা যদি জবাবদিহিতার দায়টুকু ভুলে যায় বা অস্বীকার করে, সেটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
কার্যত আনন্দবাজারের চেয়েও হয়তো এই ‘জয়াকাহিনী’ নিয়ে বেশি হৈ চৈ আর নোংরামি হয়েছে বাংলাদেশে। অনলাইন ছাড়িয়ে, ফেসবুক ছাপিয়ে মূলধারার তারকারাও এ নিয়ে নিজেদের বিজ্ঞ মতামত দিয়ে চলছেন, ‘কেন জয়া এমন করল’, ‘জয়া আমাদের দেশের মানসম্মান ডুবিয়েছে’, ‘হায় হায় জয়া এটা কীভাবে পারল’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁরা এটা ভুলে গেলেন যে একজন সত্যিকারের শিল্পী কখনো কোনো আঞ্চলিক পরিচয়ের সীমারেখায় আটকে থাকেন না। সিনেমা কোনো বাউন্ডারি বা কাঠামো দিয়ে আটকে রাখার মতো কিছু নয়। নির্মাতা যেভাবে সিনেমা বানাবেন, সেটি সেভাবেই গড়ে উঠবে। সব ছবি, সব দৃশ্য সব সংলাপ সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হতে- সিনেমা নির্মাণের কোনো ব্যাকরণ বইয়ে এমন তত্ত্ব কোনোকালেই কপচানো হয়নি। বিভিন্ন দেশে সিনেমা স্বনির্ভর এবং উন্নতভাবে বিকশিত হয়েছে এ জন্যই, যে সেখানে কোনো দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য কাউকে গালি দেওয়া হয় না বা ‘পদ্মাপারের সানি লিওন’ ধরনের উপাধি দেওয়া হয় না।
নন্দিত সার্বিয়ান পরিচালক সার্ডিয়ান স্পাসোজেভিক একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘শিল্পের কোনো সীমারেখা থাকা উচিত নয়, কারণ এটা শিল্পকে আরো ক্যাথারটিক করে তোলে। শিল্প যত বেপরোয়া হবে, বাস্তবতা ততই আমাদের হাতের নাগালে আসবে। শিল্প এবং বাস্তবতা নিশ্চিতভাবেই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।’
আমাদের জন্য শিল্প এবং বাস্তবতার এই পারস্পরিক সম্পর্ক শেষপর্যন্ত পতিতার চরিত্রে অভিনয় করে জয়া আহসানের ‘পদ্মাপারের সানি লিওন’ আখ্যা পাওয়া পর্যন্ত গড়িয়েছে! এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী-ই বা হতে পারে!
লেখক : সাংবাদিক