উৎসব
পাহাড়িদের বৈশাখ ‘বৈসাবি’
ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই আর চাকমাদের বিজু—এ তিন উৎসবের প্রথম তিন বর্ণমালা নিয়ে সাজানো হয় বৈসাবি। বহু বছর ধরে পাহাড়ে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয় বৈসাবি। বৈসাবির বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় অংশ নেয় হাজারো মানুষ। ঘিলা খেলা ও গয়াল নৃত্য বৈসাবিকে দেয় আলাদা সৌন্দর্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি আদিবাসী সমাজের বর্ষবরণ উৎসব এটি। এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি। এ উৎসব ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক, বৈসু বা বাইসু, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত।
বৈসাবি নামকরণও করা হয়েছে এ তিনটি উৎসবের প্রথম অক্ষর নিয়ে। ‘বৈ’ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, ‘সা’ শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং ‘বি’ শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো 'বৈসাবি'।
চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা এ উৎসব তিন দিন ধরে পালন করেন। এই তিন দিন হলো চৈত্রের শেষ দুদিন ও বৈশাখের প্রথম দিন। এর মাঝে চৈত্রের শেষ দিনটি এ উৎসবের মূল আকর্ষণ। এ দিন ঘরে ঘরে পাঁচ প্রকারের সবজিসহকারে বিশেষ খাদ্য পাচন রাধা হয়। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই পাচনের দৈব গুণাবলি আগত বছরের অসুস্থতা ও দুর্ভাগ্য দূর করবে। এদিন বিকেলে খেলা হয় ঐতিহ্যবাহী খেলা ঘিলা, বৌচি ইত্যাদি। তরুণীরা পানিতে ফুল ভাসিয়ে দেয়। বিজু উৎসবের এই তিন দিন কেউ কোনো জীবিত প্রাণী বধ করেন না। মারমা আদিবাসীরা বর্ষবরণের এই উৎসবকে পালন করেন সাংগ্রাই নামে। এ উৎসব চলে চার দিন ধরে। মারমারা সবাই বুদ্ধের ছবিসহকারে নদীর তীরে যান এবং দুধ কিংবা চন্দন কাঠের জল দিয়ে এ ছবিকে স্নান করায়।
এই দিনে আসন্ন পবিত্র সাংগ্রাইকে সামনে রেখে মারমারা নিজেদের বাড়ি, বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের রাস্তা পরিষ্কার করে। দিনটিতে মারমারা সবাই মিলে পবিত্র সূত্রাদি পাঠের মাধ্যমে বিহার পরিষ্কার করে থাকে। তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ১০ ভাষাভাষীর ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি ঘিরে জমজমাট হয়ে ওঠে এ এলাকার পরিবেশ।
অন্য আরো দশটা আকর্ষণের মধ্যে পানি খেলা বৈসাবির অন্যতম আর্কষণ। বৈসাবি উৎসবে পানি উৎসবটি প্রতিটি এলাকাতেই কমবেশি জনপ্রিয়। এটি বৈসাবি উৎসবেরই একটি অংশ। এ উৎসবে আদিবাসীরা সবাই সবার দিকে পানি ছুড়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন যেন গত বছরের সব দুঃখ-পাপ ধুয়ে যায়। এর আগে অনুষ্ঠিত হয় জলপূজা। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয় বলে তারা মনে করে। তা ছাড়া মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়। তা ছাড়া মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে। ভালোবাসার এমন বর্ণাঢ্য উচ্ছ্বাস, এমন বর্ণাঢ্য অনুভূতি আর কোনো 'গান্ধর্ব্য' শুধু বৈসাবিতেই সম্ভব।
বৈসাবি উৎসব ছাড়া পাহাড়ের যে আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে তারা কি নববর্ষ বরণ উৎসব করে না? চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, ম্রো, খেয়াং, লুসাই, পাঙখোয়া, চাক, বম এবং তঞ্চঙ্গ্যা জাতিগোষ্ঠীর কি কোনো নববর্ষ উদযাপনের রীতি-রেওয়াজ-সংস্কৃতি নেই? বলতে গেলে, বৈসাবি উৎসবের মধ্যেই নববর্ষ পালন করে থাকে এ সম্প্রদায়গুলো। পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিজস্ব নিয়মে বৈসাবি উৎসব পালন করে থাকে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এক বৈচিত্র্যময় রূপ ধারণ করে বৈসাবি উৎসবকে কেন্দ্র করে। আগে ছোট পরিসরে আয়োজন হলেও ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র এক বছর পর থেকে শুরু হয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সাংস্কৃতিক উৎসব ও মেলার আয়োজন। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে এ প্রথা চালু রয়েছে।
কীভাবে নতুন বর্ষবরণ করা হবে, পুরোনো বর্ষকে বিদায় জানানো হবে এবং নতুন বর্ষের কাছে তাদের চাওয়া-চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করবে—পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সব আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই এর নিজস্ব ধরন ও রীতি রয়েছে। সে অনুযায়ী তারা সেটা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঘরানায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন বর্ষকে উৎযাপন করবার স্বতন্ত্র এই রূপ ও সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত আছে। মূলত বেশ কিছু অনুষ্ঠানের সম্মিলিত রূপ হলো বৈসাবি অনুষ্ঠান।
আর পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্ষবরণের রীতি-রেওয়াজ সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে। পাহাড়ি জীবন মূলত ঋতুকেন্দ্রিক। তাই ঋতুর আগমন ও বিদায় এ মানুষদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরোনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমন এবং সে বিদায়-বরণ কেন্দ্র করে নানা ধরনের রীতিনীতি পাহাড়ি জীবনব্যবস্থার অংশ। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ জীবন ভাবনা, আনন্দ, নতুনকে বরণের আন্তরিক আয়োজন ও সাংস্কৃতিক উৎসব।
কিন্তু বাঙালির নজর পড়ার পর থেকে পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণের রূপ, রস, গন্ধ, উপস্থাপনা এবং ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন উৎসবের চেয়ে আয়োজন বেশি, আয়োজনের চেয়ে দেখানোপনা বেশি। বাংলাদেশের মিডিয়ার বেপরোয়া বিকাশের সূত্র ধরে আদিবাসীদের বর্ষবরণ উৎসব কেবল এখন আর তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক মাধুর্যে পালন করার কোনো ঋতুকেন্দ্রিক সংস্কৃতি নয়, এটা এখন বাঙালি শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্তের বিনোদনের মাধ্যমও বটে!
আজকাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা এসব অনুষ্ঠানের হয়তো সরাসরি সম্প্রচার কিংবা রঙিন ছবি ছাপাতে দেখি। বাঙালির প্রায় প্রত্যেকে আজকের এই দিনে বৈসাবির মতো অনুষ্ঠানের খোঁজখবর রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নববর্ষ বরণের যে ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত আছে, তা ‘বৈসাবি’ নামে সমাজে জারি আছে। দেশের ছাপা এবং দৃশ্য (ইলেকট্রনিক) মাধ্যমও সে অনুযায়ী বিষয়টিকে আংশিক নয়, সম্পূর্ণ রঙিনভাবে দেখানো হচ্ছে। আজকাল পাহাড়ি আদিবাসীদের বর্ষবরণের সংস্কৃতি ‘বৈসাবি উৎসব’ নামেই বাজার পেয়েছে। এবং রঙেঢঙে বাঙালির অন্যরা যেমন বৈশাখ পালন করে। পাহাড়িরা তেমনি বৈশাখের আদলে বৈসাবির উন্মাদনায় মেতে ওঠে পালন করে বৈশাখ। সবুজ পাহাড়ে এ আয়োজন পাহাড়ের পরিবেশকে করে তোলে উৎসবমুখর।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।