বিতর্কিত রানআউটের সূত্রপাত যেভাবে
বিতর্কিত এক রানআউটকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়েছে এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। নন-স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা ব্যাটসম্যানকে ক্রিজ ছেড়ে কিছুটা বাইরে থাকতে দেখে বল না করেই স্টাম্প ভেঙে দিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসার কিমো পল। ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী, সেটা আউট বলেই গণ্য হয়েছে। নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা। জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে কিমো পল অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ করেছেন বলে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটাররা। কিন্তু ক্রিকেটবিশ্বে কীভাবে শুরু হয়েছিল বিতর্কিত এই রানআউটের?
১৯৪৭ সালে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথমবারের মতো দেখা গিয়েছিল এই বিতর্কিত রানআউট। বল করার আগে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যান বিল ব্রাউনকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে স্টাম্প ভেঙে দিয়ে আউটের আবেদন করেছিলেন ভারতের বাঁহাতি স্পিনার ভিনু মানকড়। আম্পায়ারেরও সেই আবেদনে সাড়া না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। সেখান থেকেই সূচনা হয়েছিল এই বিতর্কিত রানআউটের। এই একটি ঘটনার মধ্য দিয়েই ক্রিকেট ইতিহাসে চিরস্থায়ী জায়গা দখল করে নেন মানকড়। তার পর থেকে এ ধরনের অপ্রথাগত ও কিছুটা বিতর্কিত আউটের নামই হয়ে যায় মানকড় আউট।
এর পর ক্রিকেটবিশ্বে আরো বেশ কয়েকবার এই হতাশাজনক রানআউটের ফাঁদে পড়ে সাজঘরে ফিরতে হয়েছে নন-স্ট্রাইক প্রান্তে দাঁড়ানো ব্যাটসম্যানকে। ১৯৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ইয়ান রেডপাথকে এভাবে আউট করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের চার্লি গ্রিফিথ।
ওয়ানডে ক্রিকেটে ‘মানকড় আউট’ প্রথমবারের মতো দেখা গিয়েছিল ১৯৭৫ সালে। ইংল্যান্ডের অভিষিক্ত ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লুকহ্রাস্টকে বিতর্কিত এই রানআউটের ফাঁদে ফেলে সাজঘরে ফিরিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ক্রিকেটার গ্রেগ চ্যাপেল। পরে অবশ্য চ্যাপেল দাবি করেছিলেন, এভাবে আউট করার আগে তিনি দুবার সতর্ক করেছিলেন লুকহ্রাস্টকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিন উইকেটের জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছিল ইংল্যান্ড।
১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ স্মরণীয় হয়ে আছে দুটি কারণে। ওই ম্যাচে জিওফ বয়কটকে ইচ্ছাকৃতভাবে রানআউট করে দিয়েছিলেন তাঁরই সতীর্থ ইয়ান বোথাম। বোথামের ‘সহযোগিতা’য় বয়কটকে রানআউট করেছিল কিউইরা। সে ঘটনার কিছুক্ষণ আগে ডেরেক র্যান্ডালকে মানকড় আউটের ফাঁদে ফেলেছিলেন নিউজিল্যান্ডের ডানহাতি পেসার ইয়ান চ্যাটফিল্ড। তবে ইংল্যান্ড ম্যাচটা সহজেই জিতেছিল ১৭৪ রানের ব্যবধানে।
এক বছর পরেই আবার এই বিতর্কিত রানআউটের দেখা মিলেছিল অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে। পাকিস্তানের সিকান্দার বখতকে আউট করেছিলেন অ্যালান হ্রাস্ট।
১৯৯২ সালে জিম্বাবুয়ে-নিউজিল্যান্ড ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে মানকড় আউটের ফাঁদে পড়ে সাজঘরে ফিরতে হয়েছিল গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারকে। ৬৩ রানের দারুণ ইনিংস খেলে সেঞ্চুরির পথেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন জিম্বাবুয়ের এই কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান। কিন্তু তাঁকে বিতর্কিতভাবে আউট করে দিয়েছিলেন কিউই স্পিনার দিপক প্যাটেল। নিউজিল্যান্ডও ম্যাচটা জিতেছিল চার উইকেটের ব্যবধানে।
১৯৯২ সালে এই বিতর্কিত রানআউটের ফাঁদে পড়তে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যান পিটার কারস্টেনকে। বর্ণবাদের কারণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে তখন সদ্যই আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছিল প্রোটিয়া ক্রিকেট। ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে কারস্টেনকে মানকড় আউট করেছিলেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব। মানকড় আউটের সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম নজিরটি দেখা গেছে ২০১৪ সালে। ইংল্যান্ডের উইকেটরক্ষকক জস বাটলারকে এই বিতর্কিত আউটের ফাঁদে ফেলে সাজঘরে পাঠিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান স্পিনার সচিত্রা সেনানায়েকে।
বিতর্কিত এই রানআউট করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে সতর্ক করে দেওয়ার নজিরও আছে ক্রিকেটবিশ্বে। ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যান লাহিরু থিরিমান্নেকে এভাবে আউট করে আবেদন করেছিলেন ভারতের অফস্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন। কিন্তু পরে শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দর শেবাগের হস্তক্ষেপের ফলে বেঁচে গিয়েছিলেন থিরিমান্নে। চালিয়ে গিয়েছিলেন ব্যাটিং।
খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত গড়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি পেসার কোর্টনি ওয়ালস। ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সেলিম জাফরকে মানকড় আউট করার সুযোগ থাকলেও সেটা করেননি ওয়ালস। নাটকীয় সেই ম্যাচ পাকিস্তান জিতেছিল এক উইকেটের ব্যবধানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিদায় নিতে হয়েছিল বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে।