কবে স্বীকৃতি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের!
খেলার মাঠে ‘যুদ্ধ’ করার অনন্য কীর্তি শুধুই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ এখনো কোনো জাতীয় পুরস্কার বা স্বীকৃতি মেলেনি এই দলটির। জাকারিয়া পিন্টুর মনে অবশ্য এ নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক শুধু অভিমানাহত।
সারা বছরই সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। তবে স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস এলে ফুটবলযোদ্ধাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সেসব দিনের কথা। সংগঠিত হয়ে, ফুটবল নিয়ে দেশের জন্য ‘যুদ্ধে’ নেমে পড়ার কথা ভিড় করে স্মৃতির মণিকোঠায়।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন সেই সময়ের ছাত্রনেতা এবং পিডব্লিউডির ফুটবলার সাইদুর রহমান প্যাটেল। তাঁর ভাবনা আর পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নিয়েই ঐতিহাসিক দলটির জন্ম। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে একটা ফুটবল দল গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি সেই প্রস্তাবে সানন্দে সাড়া দেন। ১৩ জুন গঠন করা হয় ৩৫ সদস্যের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
তারপর সেই ঐতিহাসিক দিন-২৪ জুলাই! সেদিন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল প্রথম ম্যাচ খেলেছিল নদীয়ার কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে। নদীয়া একাদশের বিপক্ষে ম্যাচটি ড্র হয়েছিল ২-২ গোলে। ফল যা-ই হোক, স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল ম্যাচটি।
সেই ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে নদীয়া জেলা প্রশাসকের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ওই চিঠিতে খেলা শুরু হওয়ার আগে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ তখনো স্বাধীন হয়নি বলে নদীয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক দীপক কান্তি ঘোষ পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দেননি শুরুতে। তবে পরে দর্শকদের দাবির মুখে মত পাল্টাতে বাধ্য হন তিনি। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে ১০ মিনিটের জন্য ওড়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
সঙ্গে-সঙ্গে পতাকা নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুর স্মৃতিতে আজও সে দিনটা ভাস্বর, ‘আমরা জেলা প্রসাশকের অনুমতির অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল খেলার চেয়েও মাঠে পতাকা নিয়ে নামার সুযোগ পাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ফলে আমাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হবে আর বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের পথও প্রশস্ত হবে। সেই ম্যাচ ২-২ গোলে ড্র হলেও আসলে বাংলাদেশেরই জয় হয়েছিল। পতাকা প্রদর্শন অনেক বড় অর্জন ছিল আমাদের।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ১৬টি ম্যাচ খেলেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। এর মধ্যে ৯টি জিতেছিল, ৪টি হেরেছিল আর বাকি তিন ম্যাচ ড্র করেছিল। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের জন্য পাঁচ লাখ ভারতীয় রুপির তহবিল গঠন করতে পেরেছিলেন ফুটবলাররা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিপুল জনসমর্থন তৈরি করতেও অবদান রেখেছিলেন তাঁরা।
সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছিলেন বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই)। সেই ভালোবাসার কথা আজও ভোলেননি জাকারিয়া পিন্টু, ‘আমাদের মনে সবচেয়ে রোমাঞ্চ জাগিয়েছিল মুম্বাইয়ের ম্যাচটি। আমাদের প্রতিপক্ষ মুম্বাই দলের অধিনায়ক ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদি। মাঠে উপস্থিত হয়ে আমাদের সমর্থন দিয়েছিলেন দিলীপ কুমার, সায়রা বানু, রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুরের মতো তারকারা।’
সে সময় মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে পতৌদি ব্যক্তিগতভাবে ২০ হাজার ভারতীয় রুপি দিয়েছিলেন। দিলীপ কুমারও দিয়েছিলেন সমপরিমাণ অর্থ।
অস্ত্র হাতে যুদ্ধ হয়তো করেননি, কিন্তু ফুটবল নিয়ে তাঁদের লড়াইয়ের অবদানকে খাটো করে দেখা যাবে না কিছুতেই। মুক্তিযুদ্ধের জন্য জনসমর্থন তৈরি আর তহবিল সংগ্রহে ফুটবল মাঠে উজাড় করে দিয়েছিলেন প্রত্যেকে। অথচ সেই অবদানের জাতীয় স্বীকৃতি আজও মেলেনি।
এ নিয়ে সত্তরোর্ধ্ব জাকারিয়া পিন্টুর মনে অনেক অভিমান, ‘স্বাধীনতার বয়স ৪৪ বছর হতে চলল। অথচ এখনো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল স্বাধীনতা পদক বা জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পায়নি। আমি তাই বলতে চাই, জাতীয়ভাবে আমাদের স্বীকৃতি মেলেনি। অথচ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল স্বাধীনতা পদক পাওয়ার যোগ্য দাবিদার।’
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সবচেয়ে তরুণ সদস্য ছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তূর্য হাজরা ছদ্মনাম নিয়ে খেলেছিলেন তিনি। পরিবারের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে, বাবার পরামর্শে আসল নাম আড়াল করে ফুটবল নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি সালাউদ্দিন সেজন্য গর্বিত, ‘দেশের স্বাধীনতা অর্জনে অবদান রাখতে পেরে খুব গর্ববোধ করি। এই গর্ব আমার সারা জীবনের। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের নাম তত দিন উচ্চারিত হবে। এই দলের সদস্য হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।’