ক্রিকেট উৎসবের মৌসুমে নিরুত্তাপ ভারত
ঘণ্টা কয়েক হলো পা রেখেছি বিশ্বকাপের দেশে। তবে, যে রোমাঞ্চ নিয়ে ঢাকা ছেড়েছি ভারতে এসে তা ক্রমশ কমতে থাকল। ভেবেছিলাম, বিশ্বকাপের ডামাডোল আর দূর্গাপূজার আগমনে ভারত এখন উৎসবের নগরী। এই ভাবনা যে ভুল ছিল, তা প্রমাণ হতে বেশিক্ষণ লাগল না। যাদের নাওয়া-খাওয়াজুড়ে ক্রিকেট সেই ভারত যেন বিশ্বকাপের মৌসুমে নিরুত্তাপ।
অথচ, বাংলাদেশ স্বাগতিক না হলেও ভক্তদের আগ্রহের কমতি নেই। দল হারুক কিংবা জিতুক মরিয়া হয়ে থাকে ক্রিকেটের জন্য। এই যেমন, ঢাকা থেকে যে ফ্লাইটে আসা, সেখানেও টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছিল ক্রিকেট উন্মাদনার। পাশে এক পরিবার বসেছিলেন যারা জাতিতে বাংলাদেশি হলেও থাকেন ইউরোপের দেশ জার্মানিতে। সুদূর জার্মানি থেকে ফিরে দেশে কদিন কাটিয়ে ধরেছেন কলকাতার বিমান। উদ্দেশ, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বনাম নেদারল্যান্ডসের মধ্যকার ম্যাচ গ্যালারিতে বসে দেখা। যেটি আগামী ২৮ অক্টোবর গড়াবে কলকাতার ইডেন গার্ডনে। তবে, খেলা দেখতে যাওয়া ভদ্রলোকের চিন্তা তার আগেই যদি বেজে ওঠে বাংলাদেশের বিদায়ের ঘণ্টা !
টানা তিন ম্যাচ হারা বাংলাদেশের অবস্থান বেশ নাজুক। ভদ্রলোক আশা করেছিলেন, দেশ এবার সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে সেমিফাইনাল খেলবে। কিন্তু, শুরুর চার ম্যাচেই এমন নড়বড়ে বাংলাদেশকে দেখে চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ! অবশ্য পুজোর আমেজ দিয়ে আক্ষেপ কিছুটা হলেও মেটাতে চান তিনি। আলাপে বললেন, ‘যাত্রাটা আমাদের অবশ্য বিফলে যাচ্ছে না। খেলায় যা-ই হোক, কলকাতায় দুর্গাপূজা উপভোগ করব চুটিয়ে।'
কোথায় কোন নাড়ু খাবেন, সেই গল্পও শোনালেন কিছুক্ষণ। ভদ্রলোকের গল্প শেষ না হতেই ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট ঘোষণা দিলেন–গন্তব্য চলে এসেছে। কিছুক্ষণ পরই নামলাম নেতাজি সুভাস চন্দ্র আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে। কলকাতা থেকে পরবর্তী ছিল গন্তব্য মুম্বাই। সরাসরি ফ্লাইট না পাওয়ায় পরবর্তী বিমানের জন্য অপেক্ষা ছয় ঘণ্টার।
এত ঘণ্টা কীভাবে একা কাটাবো সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা ছিল বেশ। কিছুক্ষণ ঘুরে দেখলাম বিমানবন্দরের চারপাশে। কিন্তু, আশ্চর্য একটা আইসিসি টুর্নামেন্ট চললেও কোথাও নেই তার রেশ।বরং আন্তর্জাতিক টার্মিনাল থেকে বের হয়েই চোখে পড়ল রোনালদিনহোর বড় পোস্টার। ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার এসেছিলেন দূর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে। তাকে স্বাগত জানাতে আয়োজনের কমতি রাখেনি কলকাতা। কিন্তু, ভিরাট-রোহিতরা যখন ক্রিকেটে উড়ছেন তাদের নিয়ে নেই কোনো রোমাঞ্চ।
ট্রানজিটের ছয় ঘণ্টায় দেখেছি হাজারও যাত্রী। তার মধ্যে দুই-একজনের গায়ে ছিল ভারতীয় দলের জার্সি। এ ছাড়া বলার মতো চোখে পড়েনি কিছু। এমনকি, টিভিতেও শোভা পাচ্ছে ভারতীয় সিরিয়াল।
যাই হোক, আবারও ফিরি আলোচনায়। বিরতির মাঝে এক ক্রিকেট ভক্তের দেখা পেলাম। দিব্য প্রকাশ নামের ভদ্রলোক পেশায় শিক্ষক। কিন্তু, ক্রিকেটে বেশ টান। বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ উঠতেই আফসোস ঝরল মুখে। বললেন, 'ক্রিকেট এ দেশের প্রাণ হলেও এবার বিশ্বকাপ এখনও তেমন জমল না। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে গেলাম, ভেবেছি জমজমাট লড়াই হবে। কিন্তু পাকিস্তানিরা দাঁড়াতেই পারল না। তার চেয়ে বরং বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটা ভালো হয়েছে। সাকিবকে ছাড়া বাংলাদেশ যতটুকু লড়েছে তাও কম না। তবে, সাকিব থাকলে আরও ভালো ফাইট হতো। ভারত যেভাবে খেলছে এই হোম কন্ডিশনে তাদের হাতে বিশ্বকাপটা দেখাটা মেবি খুব দূরে নয়।'
পেশায় ব্যবসায়ী মুকুল কুমার নামের একজন বললেন, 'ক্রিকেট আসলে এখন আর জমে না। খেলার চেয়ে জুয়াটাই এখন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। যারা অনলাইন বেটিংয়ে যুক্ত তারা সব খেলা দেখছে। নয়ত, উন্মাদনা আগের মতো নেই।'
ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি ফিরে গেলেন অতীতেও। বললেন, ‘আগে এক ম্যাচ জিতলেও আমরা হই হই করতাম। কপিল দেবদের সময়ে ক্রিকেট মানেই যেন আমাদের প্রাণ ছিল। কিন্তু, সেই আমেজ এই প্রজন্মের মধ্যে নেই।'
ক্রিকেটীয় নানা গল্পে কেটে গেল ট্রানজিট। কলকাতা থেকে ১৮৮৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এলাম বলিউডের শহর মুম্বাই। যে শহরে, নিজেদের পঞ্চম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। আপাতত অপেক্ষা সেই ম্যাচের!