কারখানায় কাজ করা মায়াঙ্কে মুগ্ধ ক্রিকেট বিশ্ব
লখনৌর অটল বিহারি বাজপেয়ী স্টেডিয়ামে আইপিএলের ১১তম ম্যাচের কথা। ব্যাটিং স্ট্রাইকে ছিলেন শিখর ধাওয়ান। বল হাতে লখনৌর জার্সিতে ছুটছেন ২১ বছর বয়সী এক তরুণ। তিনি যখন বল ছুঁড়লেন তখন স্পিডোমিটারে ভেসে উঠল ১৫৫.৮ কিলোমিটার! যা মোকাবিলা তো দূরে ব্যাটই ছোঁয়াতে পারলেন না পাঞ্জাব কিংসের ওপেনার ধাওয়ান।
এই তো গেল একটি ডেলিভারির কথা। বাকিগুলোর গল্পও দেড়শর আশেপাশে। নিজের প্রথম ম্যাচে ঘণ্টায় প্রায় ১৫৬ কিলোমিটার গতিতে বল করে আইপিএলে রীতিমতো হইচই ফেলে দিলেন এই তরুণ। এর পরের ম্যাচে ১৫৬.৭ কিলোমিটার গতিতে বল করে ক্রিকেটপ্রেমীদের মগ্ধ করেছে লখনৌর এই ক্রিকেটার।
গতির ঝড় তোলা এই তরুণের নাম মায়াঙ্ক যাদব। তিনি নয়াদিল্লির ছেলে। ক্রিকেটে যার পথচলা অল্প দিনের। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে খেলেছেন মোটে ১৭টি ম্যাচ। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি যাত্রা কেবল শুরু। গত ৩০ মার্চ লখনৌ সুপার জায়ান্টের হয়ে আইপিএলে অভিষেক ম্যাচে গতির জাদু দেখিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটকে চমকে দিয়েছেন তিনি। শুধু কি গতি? তার সঙ্গে আছে বাউন্সের দারুণ সম্মিলন। সবমিলিয়ে আইপিএলে প্রথমবার খেলতে নেমেই ভারতীয় ফাস্ট বোলার হওয়ার দৌড়ে নিজের নাম পাকা করে নিলেন ২১ বছর বয়সী এই তরুণ। নিজের প্রথম ম্যাচে ৪ ওভারে ২৭ রান দিয়ে তিনি নেন ৩ উইকেট। জিতেছেন ম্যাচ সেরার পুরস্কারও। পরের ম্যাচেও একই চিত্র। সেটিতে মাত্র ১৪ রান দিয়ে নিয়েছেন তিনটি। হয়েছেন ম্যাচ সেরা।
এই রোগাপাতলা ছেলেটিই এক সময় কাজ করতেন দিল্লির এক কারখানায়। পুলিশের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বানানোর কাজ চলত কারখানাটিতে। কারখানা থেকে তার বাড়ি মোতিনগর কয়েক কিলোর দুরুত্ব। দিনের কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ভেঙ্কাটেশ্বরা কলেজে অনুশীলন করা সনেট ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে বোলিং করেছিলেন মায়াঙ্ক। সেই তো শুরু।
তবে, তার পেস বোলিংয়ের প্রতি প্রেমটা শুরু বাবার থেকেই। মায়াঙ্কের বাবার পছন্দই যে কোর্টনি অ্যামব্রোস। ছেলেও তাই ঝুঁকেন পেসের দিকে। তার পছন্দ আবার দক্ষিণ আফ্রিকার গতির বারুদ ডেল স্টেইন। দিল্লির এই তরুণ সনেট ক্লাবের অনুশীলনেই মুগ্ধ করেন তারক সিনহা ও দেবেন্দ্র শর্মাদের। নয়াদিল্লির সনেট ক্লাবের ট্রায়ালে মায়াঙ্কের গতিতে অবাক হয়েছিলেন তারা। ওই সময় পরিস্থিতি এমন ছিল যে, মায়াঙ্কের বল যে দেখতেই পাচ্ছিল না ব্যাটাররা। তার বল হাত থেকে বেরচ্ছে, পিচে পড়ছে, সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে।
তারক সিনহার যে জহুরির চোখ সেটা কারও অজানা নয়। তিনিই তো খুঁজে বের করেছেন শিখর, ইশান্ত শর্মা, ঋষভ পন্থদের মতো তারকাদের। এবার তার নয়া আবিস্কার মায়াঙ্ক।
সেদিন ট্রায়ালে দেখেও ভুল করেননি পোড়খাওয়া কোচ। সেই থেকে শীর্ণকায় ছেলেকে তালিম দেওয়া শুরু হয়। বল করার জুতা ছিল না। কিনে দেওয়া হয় জুতা। লাইন-লেংথ নিয়ে শুরু হয় পরিশ্রম। এরপর সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষা। কাঙ্খিত সুযোগ এসে যায় ২০২২ সালেই। আইপিএলের নিলামে সে বছর মাত্র ২০ লাখ রুপিতে কিনে নেয় লখনৌ। কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচের পর হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পাওয়ায় খেলা হয়নি সেবার। রত্ন চিনতে ভুল করেনি লখনৌ। তাইতো রেখে দিয়েছেল সেই মায়াঙ্ককে। অবশেষে এলো বল হাতে বড় মঞ্চে মাতানোর সুযোগ। গত শনিবার সেই সুযোগটাই দারুণভাবে কাজে লাগালেন তিনি। বুঝিয়ে দিলেন তিনি এসেছেন ভারতীয় ক্রিকেট মাতাতে, ফুরিয়ে যেতে আসেননি।
প্রথম দিনের বোলিং শেষে তো অবশ্য নিজের আইডলের মনও জয় করে ফেলেছেন তিনি। তার প্রিয় তারকা ডেল স্টেইন মায়াঙ্কের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ লিখে ফেলেছেন, ‘১৫৫.৮ কিলোমিটার! মায়াঙ্ক যাদব, এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলে!'
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গতিতারকা ব্রেট লিও অবাক। মায়াঙ্কে মুগ্ধ হয়ে তিনেও লিখেছেন—‘ভারত তাদের দ্রুততম বোলার খুঁজে পেয়েছে। মায়াঙ্ক যাদব! দুর্দান্ত!’