ইউক্রেন সংকট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর
ইউক্রেন ইস্যু ঘিরে ইউরোপে এখন চরম উত্তেজনা। একদিকে রয়েছে রাশিয়া, যারা ইউক্রেনের সীমান্তে লাখখানেক সেনা এনে রেখেছে বলে দাবি পশ্চিমা দেশগুলোর। পালটা জবাবে ন্যাটো জোটও তাদের সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। ইউক্রেনে কোনো অভিযান চালালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ব্যবস্থার হুমকি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা।
কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম ইউরোপ আবার একটি বড় ধরনের যুদ্ধের মুখোমুখি–এমন আশঙ্কা করছেন অনেকে।
কিন্তু, ইউক্রেনকে ঘিরে এ উত্তেজনা ও সংঘাত আসলে কেন? রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আসলে কী চান? ন্যাটো জোট কী করছে? ইউক্রেন সংকট নিয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
রাশিয়া কি সত্যি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে?
রাশিয়া বারবার জোর গলায় এমন কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করে বলছে—ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে না তারা।
তবে, রাশিয়া অতীতে ইউক্রেনের ভূমি দখল করেছে। এ মুহূর্তে রাশিয়ার প্রায় এক লাখ সৈন্য ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে মোতায়েন আছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাশিয়া বহুদিন ধরেই চেষ্টা করছে—ইউক্রেন যেন কোনোভাবেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে না যায়।
রাশিয়ার আরও আপত্তি ন্যাটো জোট নিয়ে। ইউক্রেন এখনও ন্যাটো জোটের সদস্য নয়। কিন্তু, পূর্ব ইউরোপের আরও অনেক সাবেক কমিউনিস্ট দেশের মতো, ইউক্রেনও সে পথে হাঁটছে বলে মনে করছে রাশিয়া।
এ মুহূর্তে ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্ত এলাকায় তীব্র সামরিক উত্তেজনা রয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—পশ্চিমা দেশগুলো যদি তাদের আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি না বদলায়, তাহলে ‘যথাযথ পালটা সামরিক-কারিগরি’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মনে করেন—একটা সংঘাতের বাস্তব আশঙ্কা রয়েছে। আর, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বাস করেন—রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালাবে।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে—রাশিয়া কেন ইউক্রেন সীমান্তের কাছে এত সৈন্য পাঠিয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। বেলারুশেও রাশিয়ার সৈন্যরা যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, রাশিয়া এ বছরের প্রথম ভাগেই কোনো এক সময়ে ইউক্রেনে ঢুকবে।
রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বর্তমান সংকটকে ‘কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৯৬২ সালের সে সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি পরমাণু যুদ্ধের প্রায় দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল।
ইউক্রেনকে ঘিরে এ সংঘাতের শুরু কীভাবে?
যদি সাম্প্রতিক ইতিহাসের কথা বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে—২০১৪ সালে। যদিও এ সংকটের আসল কারণ বুঝতে হলে যেতে হবে আরও পেছনে, সোভিয়েত আমলে। সে সময় ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল।
পূর্ব ইউরোপের, আর কিছু কমিউনিস্ট দেশ এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মতো, ইউক্রেনেও দুটি রাজনৈতিক ধারা বেশ স্পষ্ট। একটি অংশ চায়—পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগ দিতে এবং নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হতে।
আর, অপর অংশ রুশ প্রভাব বলয়ে থাকার পক্ষপাতী। কারণ, ইউক্রেনের জনসংখ্যার বিরাট অংশ রুশ ভাষাভাষী। তারা জাতিগতভাবেও রুশ। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক যোগাযোগ।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থি প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন বিক্ষোভের মুখে। এরপর তাঁকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।
প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চেয়েছিলেন। একদিকে তিনি মস্কোকে ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখিয়ে চলেছিলেন, আবার পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গেও মাখামাখি করছিলেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন তারপরও তাঁকে সহ্য করেছেন।
কিন্তু, ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ যখন ইইউ’র সঙ্গে একটি বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি করতে চাইলেন, যা প্রকারান্তরে ইইউ’র সদস্যপদ পাওয়ার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া, তখন পুতিন ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করলেন।
এরপর যখন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইইউ’র সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা ভেঙে বেরিয়ে এলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে ইউক্রেনে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। ইয়ানুকোভিচের পতনের পর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়, যা পুতিনকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
ইউক্রেনের ভেতরে রুশ অধ্যুষিত অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে রাশিয়া তাতে সমর্থন দেয়। এ বিদ্রোহীদের সমর্থনে রুশ সৈন্যরা হস্তক্ষেপ করে। একপর্যায়ে রাশিয়া ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে সেটি নিজেদের অংশ বলে ঘোষণা করে।
রাশিয়া কেন ক্রিমিয়াকে নিজের সীমানাভুক্ত করল?
রাশিয়া এক বিশাল দেশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ দেশ ১১টি টাইম জোনজুড়ে বিস্তৃত। আয়তনে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ, ভারতের পাঁচগুণ এবং বাংলাদেশের চেয়ে ১১৫ গুণ বড়। কিন্তু, দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ১৪ কোটি ৪০ লাখ, যা বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া বা পাকিস্তানের চেয়েও কম।
প্রশ্ন উঠতেই পারে—এত বড় একটি দেশের ক্রিমিয়া দখল করে নিজের সীমানাভুক্ত করার কী এমন দরকার ছিল?
রাশিয়া যত বড় দেশ, তাদের সমস্যাও বড়—সারা বছর সচল রাখা যায় উষ্ণ পানির এমন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর দেশটির নেই বললেই চলে। ক্রিমিয়ার সেভাস্তাপোলে রাশিয়ার যে নৌ-ঘাঁটি, সেটি কৌশলগত কারণে তাই রাশিয়ার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার ঢোকার পথ হচ্ছে এ বন্দর। সেটি কোনোভাবেই হাতছাড়া হতে দিতে চায়নি তারা।
প্রায় ২০০ বছর ধরে ক্রিমিয়া কিন্তু রাশিয়ারই অংশ ছিল। ক্রিমিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষও জাতিগত রুশ। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এটি হস্তান্তর করেন তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছে। তখন কেই বা ভেবেছিল কোনো একদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে, এবং ক্রিমিয়ার ওপর মস্কো নিয়ন্ত্রণ হারাবে।
কাজেই ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে, তা রাশিয়া কোনোভাবেই মানবে না। কিন্তু মস্কো যখনই দেখল যে, ইউক্রেন তাদের প্রভাবের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখনই পুতিন সেখানে হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিলেন।
লেখক-সাংবাদিক টিম মার্শালের মতে, কোনো বৃহৎ শক্তির অস্তিত্ব যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন সে বলপ্রয়োগ করবেই। এটা কূটনীতির এক নম্বর শিক্ষা।
টিম মার্শাল তাঁর ‘প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি’ বইতে লিখেছেন, ‘আপনি হয়তো যুক্তি দিতে পারেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সামনে বিকল্প ছিল। তিনি ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারতেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে—পুতিন আসলে রাশিয়ার ঈশ্বর-প্রদত্ত ভৌগোলিক হাত নিয়ে খেলছেন এখানে।’
‘কাজেই ইউক্রেনের ব্যাপারে কিছু না করে বসে থাকার কোনো সুযোগ তাঁর (পুতিন) ছিল না। কারণ, ক্রিমিয়া ছিল রাশিয়ার একমাত্র উষ্ণ জলের বন্দর। আর, পুতিনের আমলেই এ বন্দর রাশিয়ার হাতছাড়া হবে—সেটা তিনি চাননি’, যোগ করেন টিম মার্শাল।
রাশিয়া নিজেকে এখনও একটি পরাশক্তি হিসেবেই দেখে। এবং বিশ্বে তার সে সামরিক-রাজনৈতিক শক্তি অটুট রাখার ক্ষেত্রে ক্রিমিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব তাই অনেক।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কাছে রাশিয়ার দাবি কী?
ইউক্রেন এখনও ন্যাটোর সদস্য নয়। তবে, তাদের সঙ্গে ন্যাটোর সখ্য রয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো একদিন তারা ন্যাটো জোটের সদস্য হবে—এমন একটা বোঝাপড়া রয়েছে। তবে, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে নিশ্চয়তা চায় যেন এমন কিছু কখনোই না ঘটে। কিন্তু, পশ্চিমা দেশগুলো সে নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয়।
আগেই বলা হয়েছে—ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জাতিগতভাবে রুশ। তাদের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আছে। রাশিয়া কৌশলগতভাবে ইউক্রেনকে তার বাড়ির পেছনের আঙিনা হিসেবে দেখে।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন—পশ্চিমা শক্তি আসলে ন্যাটো জোটকে ব্যবহার করে চারদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছে। তিনি চান—ন্যাটো যেন পূর্ব ইউরোপে তার সামরিক তৎপরতা কমিয়ে আনে।
পুতিন বহুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন—১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটকে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা রাখেনি। তবে, ন্যাটো রাশিয়ার এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলছে—ন্যাটো জোটের মাত্র অল্প কয়েকটি দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্ত রয়েছে। আর, ন্যাটো হচ্ছে একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট।
অনেকের বিশ্বাস—ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার যে বিশাল সৈন্য সমাবেশ, তার উদ্দেশ্য আসলে রাশিয়ার নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়গুলো যাতে পশ্চিমারা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, তাতে বাধ্য করা।
এদিকে, ইউক্রেনকে ন্যাটো সামরিক জোটে ঢুকতে না দেওয়ার যে দাবি রাশিয়া জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তা নাকচ করে দিয়েছে। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ঠিক তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন রাশিয়ার কাছে পাঠানো এক আনুষ্ঠানিক জবাবে এ কথা জানিয়েছেন।
ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন–তাদের জবাবও মস্কোর কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, রাশিয়ার উদ্বেগের বিষয়গুলো তিনি শুনতে রাজি আছেন, কিন্তু এটাও বুঝতে হবে—প্রত্যেক দেশের তার নিজের মতো করে প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে।
রাশিয়ার মতো সামরিক শক্তি কেন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন?
ব্রিটিশ সাংবাদিক টিম মার্শাল তাঁর লেখা বেস্টসেলার ‘প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি’ বইয়ে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
টিম মার্শাল লিখেছেন, অনেক ভাবতে পারেন—রাশিয়ার মতো এত বড় একটি সামরিক ক্ষমতাধর দেশকে কে আক্রমণ করতে চাইবে! কিন্তু, রাশিয়া নিজে বিষয়টি সেভাবে দেখে না। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে।
গত ৫০০ বছরে রাশিয়া বহু বিদেশি শক্তির আক্রমণের মুখে পড়েছে। আর, সবগুলো আক্রমণই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে। ১৬০৫ সালে পোলিশরা আক্রমণ চালিয়েছিল এ পথ ধরে। এর পরে আসে সুইডিশরা। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফরাসিরা। জার্মানরা রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছে দুবার—১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, আবার ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
১৮১২ সালে নেপোলিয়নের সময় থেকে হিসাব করলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে প্রতি ৩৩ বছরে রাশিয়াকে উত্তর ইউরোপের সমতলভূমিতে একবার করে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কাজেই রাশিয়ার ধারণা—তাদের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি যদি থেকে থাকে, সেটি এ পথেই আসবে।
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভেঙে গিয়েছিল, সেটিকে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার জন্য ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন। এরপর থেকে রাশিয়া কেবল উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে—কীভাবে ধীরে ধীরে ন্যাটো সামরিক জোট চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলছে।
১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিল। ২০০৪ সালে তাদের পথ অনুসরণ করল বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়েনিয়া, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া। আর, ২০০৯ সালে যোগ দিল আলবেনিয়া।
উপর্যুক্ত সবগুলো দেশ এক সময় হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য ছিল।
জর্জিয়া, মলদোভা বা ইউক্রেন পারলে যখন-তখন ন্যাটো বা ইইউ-তে যোগ দেয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কারণেই তাদের যোগ দেওয়া হয়নি। কারণ, এ তিন দেশেই রুশপন্থি মিলিশিয়াদের শক্ত অবস্থান রয়েছে। এ দেশগুলোর যেকোনো একটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ হয়ে দেখা দিতে পারে।
টিম মার্শাল লিখেছেন, গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতে কে ভেবেছিল—মস্কো থেকে মাত্র কয়েকশ মাইল দূরে পোল্যান্ডের মাটিতে বা বাল্টিক দেশগুলোতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা থাকবে? তাঁর মতে, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর সামরিক বাহিনী একেবারে রাশিয়ার পেটের ভেতরে এসে অবস্থান নেওয়া। নিজের দোরগোড়ায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া সঙ্গত কারণেই এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখে।
ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার গ্যাস কেন বড় ইস্যু?
পরমাণু অস্ত্রের কথা বাদ দিলে, রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র কিন্তু তার সেনাবাহিনী বা বিমানবাহিনী নয়। রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার বিপুল জ্বালানিভান্ডার।
ইউরোপের মোট তেল ও গ্যাস সরবরাহের এক-চতুর্থাংশ আসে রাশিয়া থেকে। লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল।
এ ছাড়া জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। জার্মানির রাজনীতিকেরা কেন রাশিয়ার সমালোচনায় অতটা সরব নন, এ তথ্য থেকেই তা বোঝা যায়।
আর, ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন হলো রাশিয়ার প্রবেশদ্বার। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপলাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ যায় এ পাইপলাইন দিয়ে।
কাজেই, ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া নিজের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করে।
তবে, ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ নামের নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে। কিন্তু, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে এ ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প আর সামনে এগোবে না বলে এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এক হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এ গ্যাস পাইপলাইন জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি দ্বিগুণ করবে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রুশ অর্থায়নে নির্মিত এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
জার্মানিও গত বৃহস্পতিবার জানিয়ে দিয়েছে, ইউক্রেনে হামলা চালালে এ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
ইউরোপ যেভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাতে করে রাশিয়া অন্যান্য দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মনে করে, রাশিয়া চাইলে যেকোনো সময় এসব গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে, এবং সামনের দিনগুলোতে এ জ্বালানিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বারবার ব্যবহার করতে পারে।
ইউক্রেন প্রশ্নে ন্যাটো কি ঐক্যবদ্ধ?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলছেন—ইউক্রেন প্রশ্নে ইউরোপীয় নেতারা সবাই একমত। তবে, বিভিন্ন দেশ যে ধরনের সমর্থন দেবে বলে কথা দিচ্ছে, তার মধ্যে পার্থক্য আছে।
যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনে ৭০ টনের মতো ‘প্রাণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম’ পাঠিয়েছে, যাতে রণাঙ্গনের সামনের কাতারে প্রতিরোধ তৈরি করা যায়। যুক্তরাজ্য স্বল্পমাত্রার ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে ইউক্রেনকে। কিছু ন্যাটো দেশ, যেমন—ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস তাদের যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ পূর্ব ইউরোপে পাঠাচ্ছে সেখানকার প্রতিরক্ষাকে জোরালো করতে।
তবে, জার্মানি ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও কোনো অস্ত্রশস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কারণ, দেশটির নীতিই হচ্ছে কোনো সংঘাতপূর্ণ এলাকায় প্রাণঘাতী অস্ত্র না পাঠানো। এর পরিবর্তে জার্মানি মেডিকে ত্রাণ সাহায্য পাঠাবে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ অবশ্য উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এর জন্য মিত্রদের কাছে সমালোচিতও হয়েছেন ম্যাক্রোঁ।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো কী ব্যবস্থা নিতে পারে?
পশ্চিমা দেশগুলো মূলত মারাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাই বলছে। যদিও তারা স্পষ্ট করে বলছে না, এ নিষেধাজ্ঞা ঠিক কেমন হবে।
যে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে, তা হলো—আন্তর্জাতিক আর্থিক বার্তা লেনদেন পরিষেবা ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়া। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, একে একটি মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর পক্ষে আন্তর্জাতিক লেনদেন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
বিশ্বে দুইশো’র বেশি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘সুইফট’ পরিষেবা ব্যবহার করে।
এর আগে ২০১২ সালে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে, এরকম নিষেধাজ্ঞায় হিতে বিপরীতও হতে পারে। কারণ, রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মার্কিন ও জার্মান ব্যাংকগুলোর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাশিয়াকে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। যার মানে দাঁড়াবে—রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একেবারে সীমিত হয়ে পড়বে। এর বিরাট প্রভাব পড়তে পারে রুশ অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক ঋণ বাজার থেকে যাতে রাশিয়া ঋণ করতে না পারে, সেরকম নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে পুতিন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে।
এর বাইরে পশ্চিম ইউরোপে রাশিয়া যে জ্বালানি বিক্রি করে, সেটি বন্ধ করার কথাও আলোচনায় আসছে। কিন্তু, এর কোনো বিকল্প এখন পর্যন্ত জার্মানি বা অন্য দেশগুলোর নেই।
পশ্চিমা দেশগুলোর নিজেদের মধ্যেই আসলে মতবিরোধ রয়েছে যে, তারা রাশিয়াকে শাস্তি দিতে কতদূর পর্যন্ত যাবে।