তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নজর কেন বিশ্ববাসীর
হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ পর্যন্ত ঠেকে দ্বিতীয় দফায় গিয়ে। এই দফায় ভোটের আর বাকি সপ্তাহখানেক। সেই ভোটের দিকেই তাকিয়ে আছে বিশ্ববাসী। কারণ, এই পদে প্রথম ধাপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এগিয়ে থাকা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি রাশিয়া চীনের কাছেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের পর্যন্ত সকলের সঙ্গে যোগাযোগের লাইনে পরিণত হয়েছেন তিনি। এ ছাড়া এশিয়ার বেশ কিছু দেশেও রয়েছে তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব। আবার তার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির কারণও হয়েছে। এদিকে, ন্যাটোভুক্ত দেশ হওয়ায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি বিশ্বের নজর টেনে রাখে।
আজ শনিবার (২০ মে) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। এই প্রতিবেদন বলছে, তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দুই দশক ধরে দেশটির ক্ষমতায় রয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমা বিশ্ব উভয়ের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছেন তিনি। কিন্তু, এরদোয়ানের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসন তার কিছু রাজনৈতিক মিত্রদের অপছন্দ। এতে করে তাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সম্পর্ক অবনতি হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে এরদোয়ানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা ও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কেমাল কিলিকদারোগলু। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তুরস্কের বেশ কিছু নাগরিক এই নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন কিলিকদারোগলুর উদ্দেশে। তুর্কিদের প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে বিশ্বমঞ্চে তুরস্কের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পারবে কিনা ও দেশের নিরাপত্তায় তার অঙ্গীকার কি? এই দুটি ক্ষেত্রে ট্রেডমার্ক করে দিয়ে গেছেন এরদোয়ান।
গত ১৪ মে তুরস্কের পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই দুটোর মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এরদোয়ানের একে পার্টির জোট। তবে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোট পাননি।
এই নির্বাচনের আগে হওয়া জরিপগুলোতে এগিয়ে ছিলেন কিলিকদারোগলু। তবে, ভবিষ্যতদ্বাণীকে পেছনে ফেলে ভোট গণনার শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলেন এরদোয়ান। আর ভোট গণনার সঙ্গে সঙ্গে এগুতে থাকে কিলিকদারোগলু। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ান পান ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোট। আর তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিকদারোগলু পান ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট।
তুরস্ককে দোদুল্যমান একটি দেশ হিসেবে অবিহিত করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সাবেক পররাষ্ট্র নীতির প্রধান বারোনেস আস্থন। এই কূটনীতিক বলেন, ‘তুরস্ক এমন একটি দেশ, যেটিকে আমি দোদুল্যমান বলে সম্বোধিত করব। দেশটির গণতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে যা ঘটে তা ইউরোপ, এশিয়া ও সমস্ত বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যা আমরা সকলেই মোকাবিলা করছি। এটি সত্যিই।’
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর থেকেই, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুরস্ক নিজের কূটনৈতিক অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। প্রথম অবস্থানের আলোচনায় দেশটি কোনো প্রভাব না ফেলতে পারলেও কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি চুক্তির দিকে প্রধান অবস্থানে ছিল তুরস্ক।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের পর্যন্ত সকলের সঙ্গে যোগাযোগের লাইনে পরিণত হয়েছেন এরদোয়ান। বিষয়টি নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বেশ গর্ববোধ করেন।
ইস্তাম্বুলের ওজিগিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইভরেন বাল্টা বলেছেন, “তুরস্ক সবসময়ই পশ্চিমের অংশ হতে চেয়েছে। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাদের সবসময় ছিল। এরদোয়ানের দুই দশকের শাসনামলেও এই চিন্তার পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু, তুরস্কের আন্তর্জাতিক জোটে বৈচিত্র্য এসেছে। তারা যা করছে, সেটিকে আমরা ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ বলি। এর মাধ্যমে একটি দেশ একাধিক রাষ্ট্র বা সুরক্ষা ছাতার তলে থাকতে পারে।”
বিবিসি বলছে, তুরস্কের একাধিক দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও তাদের ভেলকির জন্য তারা মূল্যবান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে, সবকিছু অতটা সহজ নয়। অর্থাৎ, যা দেখা যাচ্ছে, সব তা নয়।
ন্যাটেতে তুরস্কের শক্ত অবস্থান
ন্যাটো জোটভুক্ত দেশ তুরস্ক। দেশটির মোট সেনাবাহিনী সদস্যের সংখ্যা ন্যাটোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে ন্যাটোতে নিলে জোটটির নিরাপত্তার অবস্থা আরও জোরদার হবে বলে জানিয়েছে তুরস্ক। আবার ফিনল্যান্ডকে জোটে নেওয়ার গতিও কমিয়েছে দেশটি। এমনকি, সুইডেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়াও স্থবির করে রেখেছে তারা।
১৯৮৪ সাল থেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানো কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিকেকের কয়েক ডজন সদস্যকে সুইডেন থেকে না ফেরানো পর্যন্ত তারা সুইডিশ সদস্যপদ সমর্থন করবে না। এর মাধ্যমে এক তুরস্কের দুই রূপ প্রতিফলিত হয়। আঙ্কারা পলিসি সেন্টারের লন্ডন প্রতিনিধি সেলিন নাসি মনে করেন, প্রেসিডেন্টের পরিবর্তন ন্যাটোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের জন্য সহায়ক হতে পারে।
ক্ষমতায় গেলে কিলিকদারোগলু তথাকথিত এস ৪০০ ইস্যু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই এস ৪০০ ইস্যুটি হলো, তুরস্ক প্রতিরক্ষার জন্য রাশিয়ার তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেমের ব্যবহার করছে যেটি কি না যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রোগ্রামের সঙ্গে বেমানান বলে ধরা হয়। ২০১৯ সালে এফ-১৯ যুদ্ধবিমানগুলো সরিয়ে ফেলে এরদোয়ান সরকার। তবে, ক্ষমতায় গেলে এই যুদ্ধবিমানগুলো ফের সক্রিয় করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিলিকদারোগলু।
বিষয়টি নিয়ে সেলিম নাসি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে তুরস্ক একটি মিত্র। কিন্তু, ন্যাটোর প্রতি তার আনুগত্য এবং প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধ।’
ইন্দোনেশিয়ার বালিতে হওয়া জি-২০ সম্মেলনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে নাসি বলেন, ‘সেখানে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর একটি জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। তবে, সেখানে তুরস্ককে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এটি ন্যাটোর মধ্যে তুরস্কের অস্পষ্ট অবস্থান প্রদর্শন করে। এই সন্দেহ কাটাতে তুরস্ককে এস ৪০০ ইস্যুটির সমাধান করতে হবে জরুরিভাবে।’
দোদুল্যমান ইউরোপীয় ইউনিয়ন পদ
ন্যাটোর পরেই আসে ইইউর কথা। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তুরস্ক। ১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউর সদস্য পদের প্রার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল তারা। তবে, ২০১৬ সালে এই প্রক্রিয়াটি থেমে যায়। তুরস্ককে সদস্য পদ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করে ব্রাসেলস জানিয়েছিল, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের স্বাধীনতা নিয়ে আঙ্কারা ভুল তথ্য দিচ্ছে। এ নিয়ে সমালোচনাও করে ব্রাসেলস।
নির্বাচনের আগে কিলিকদারোগলু ও এরদোয়ানের বিরোধীরা বলেছিল, তারা ক্ষমতায় গেলে ইইউতে প্রবেশের প্রক্রিয়ায় জোর দেওয়া হবে। তবে, এটি কী হতে পারে, তা নিশ্চিত নয়।
এরদোয়ানের প্রধান উপদেষ্টা ইলনুর কেভিক বলেন, ‘বিরোধীরা যে করতে চাচ্ছে তা আদৌ হবে না। পূর্ণ সদস্য পদ পেতে ইইউ সবসময় আমাদের রাস্তা অবরোধ করছে।’