সাগরে ডোবা যুদ্ধবিমানের খোঁজে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া কেন?
দক্ষিণ চীন সাগরে ডুবে যাওয়া একটি মার্কিন যুদ্ধবিমানের সন্ধান আগে পেতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নৌবাহিনী। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
দশ কোটি মার্কিন ডলারের এফ-৩৫সি সিরিজের ফাইটার প্লেনটি মার্কিন রণতরী ইউএসএস কার্ল ভিনসন থেকে উড্ডয়নের সময় পড়ে গিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরে ডুবে যায়।
মার্কিন নেভির ভাষ্য—এটি একটি ‘দুর্ঘটনা’। নেভির একেবারে সাম্প্রতিক অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নতুন উড়োজাহাজটি বিশেষায়িত এবং গোপন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতিতে ঠাসা।
প্লেনটি যেহেতু আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় পড়েছে, আইন অনুযায়ী যেকোনো দেশ এটি উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারে। তাই, এ প্লেনের কাছে আগে যে দেশ পৌঁছাবে, তারাই এর মালিকানা দাবি করতে পারবে।
আর, এফ-৩৫সি উড়োজাহাজটি উদ্ধারের সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো—অত্যন্ত দামী এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আকাশযানটির সব রহস্য জানার সুযোগ।
সেনা মহড়ার সময় গত সোমবার ডুবে যাওয়ার আগে এফ-৩৫সি প্লেনটি রণতরী ভিনসনের ডেকে আঘাত করে। এতে সাত নাবিক আহত হন।
উড়োজাহাজটি এখন সমুদ্রের তলদেশে পড়ে আছে। কিন্তু, এটি নিয়ে এরপর কী করা হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। উড়োজাহাজটি ঠিক কোন অবস্থানে রয়েছে বা এটি উদ্ধার করতে কত সময় লাগতে পারে—এসব তথ্য প্রকাশ করছে না মার্কিন নেভি।
দক্ষিণ চীন সাগরের প্রায় পুরোটা নিজেদের বলে দাবি করে চীন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের এ দাবি পাকাপোক্ত করার জন্য নানা পদক্ষেপও নিয়েছে তারা। ২০১৬ সালে এক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছিল—চীনের এ দাবির পেছনে কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। তবে, চীন ওই রায় মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞেরা বলছেন—চীনের সেনাবাহিনী এফ-৩৫সি প্লেনের কাছে পৌঁছাতে ‘অত্যন্ত উদগ্রীব’। একটি উদ্ধারকারী মার্কিন জাহাজ ঘটনাস্থল থেকে ১০ দিনের দূরত্বে রয়েছে বলেও বলছেন তাঁরা।
তবে, এফ-৩৫সি প্লেনের কাছে যেতে ১০ দিন লাগলে অনেক দেরি হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন প্রতিরক্ষা বিষয়ক পরামর্শদাতা আবি অস্টেন। তিনি মনে করেন, ১০ দিনের মধ্যে প্লেনটির ব্ল্যাক বাক্সের ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে। এবং তখন প্লেনের অবস্থান চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
আবি অস্টেন বলেন, “প্লেনটি ফিরে পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এফ-৩৫ আসলে উড়ন্ত কম্পিউটারের মতো। অন্যান্য যুদ্ধ উপকরণের সঙ্গে সংযোগ করার জন্য প্রস্তুত করে এটি তৈরি করা হয়েছে। বিমানবাহিনীর ভাষায়—এটি ‘সেন্সরের সঙ্গে শুটারের সংযোগ’ তৈরি করে।”
‘চীনের কাছে এমন প্রযুক্তি নেই। তাই, চীন যদি এ প্লেনের দখল নিতে পারে, তাহলে সেটি হবে তাদের জন্য বড় ধরনের অগ্রগতি’, বলছেন প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা অস্টেন।
কী আছে এফ-৩৫সি প্লেনে?
এফ-৩৫সি প্লেনে রয়েছে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত মিশন সিস্টেম। যার ফলে প্লেনটি চলাকালীন এটি তাৎক্ষণিকভাবে ওই সময়ের তথ্য সরাসরি আদান-প্রদান করতে সক্ষম।
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর প্রথম ‘লো অবজার্ভেবল’ ক্যারিয়ারভিত্তিক প্লেন, যেটি শত্রুর আকাশসীমায় শনাক্ত না হয়ে অভিযান চালাতে সক্ষম।
অপেক্ষাকৃত বড় পাখা এবং আরও শক্তিশালী ল্যান্ডিং উপকরণ থাকায় এফ-৩৫সি প্লেন রণতরী থেকে আক্রমণ চালাতে পারে।
এফ-৩৫সি প্লেনে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ফাইটার ইঞ্জিন। এটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ এক হাজার মাইল পর্যন্ত গতি তুলতে পারে।
প্লেনটি দুই পাখায় দুটি এবং ভেতরে আরও চারটি ক্ষেপণাস্ত্র (মিসাইল) বহন করতে পারে।
তাই, চীন যে এমন প্লেনের দখল নিতে চাইবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
যদিও সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির কল্যাণে প্লেনটির ভেতরে কী আছে এবং এটি কীভাবে কাজ করে—এ বিষয়ে এরই মধ্যে চীনের কিছু জ্ঞান আছে বলে ধারণা ব্রাইস ব্যারসের। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা ট্রুম্যান প্রজেক্টের নিরাপত্তা বিষয়ক ফেলো এবং চীন বিষয়ক বিশ্লেষক।
ব্রাইস ব্যারস বলেন, ‘আমার মনে হয় চীন বিস্তারিত বোঝার জন্য প্লেনটির অংশবিশেষ দেখতে চাইবে। যাতে এটি কীভাবে তৈরি করা হয়েছে তা বুঝতে পারে এবং প্লেনটির দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে পারে।’
উদ্ধার কাজ কীভাবে চালানো হবে?
মার্কিন নেভির একটি উদ্ধারকারী ও ডুবুরি দল প্লেনটির মূল কাঠামোর সঙ্গে ব্যাগ সংযুক্ত করবে। ধীরে ধীরে সেসব ব্যাগ ফোলানো হবে এবং প্লেনের ধ্বংসাবশেষ এর সাহায্যে পানির ওপরে ভেসে উঠবে।
তবে, প্লেনের মূল কাঠামোটি যদি মোটামুটি অখণ্ড না থাকে, তাহলে এ পদ্ধতিতে প্লেন উদ্ধার করা কঠিন হয়।
সাগরে ডুবে যাওয়া প্লেনটিতে অন্তত দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছিল বলে জানা যাচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো হয় প্লেনের দুই পাখার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল অথবা প্লেনের ভেতরে ছিল, যা উদ্ধার করা জটিল হয়ে যেতে পারে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এ ইঁদুর দৌড়ে চীন জিতলে, তাদের লাভ বেশি। ইতিহাসে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।
১৯৭৪ সালে যখন স্নায়ুযুদ্ধ চরম উত্তেজনাকর অবস্থায়, তখন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ একটি দৈত্যাকার হাতের মতো যন্ত্র ব্যবহার করে হাওয়াই উপকূলে গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে অতি গোপনে একটি রুশ সাবমেরিন তুলে নেয়।
এর দু বছর আগে চীন গোপনে একটি ব্রিটিশ সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করে। ‘এইচএমএস পসাইডন’ নামের সাবমেরিনটি নিমজ্জিত হয়েছিল চীনের পূর্ব উপকূলে।
অনেকের ধারণা—যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোপন ‘স্টেলথ’ (প্রতিপক্ষের রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম) হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ চীনের হস্তগত হয়েছিল। ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনের বাড়িতে অভিযান চলাকালে হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হয়।
ব্রাইস ব্যারস বলছেন, ‘আমরা নিশ্চিত যে, চীনের সেনাবাহিনী ওই হেলিকপ্টারে থাকা যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দেখার একটা সুযোগ তখন পেয়েছিল।’
সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর তলদেশ থেকে ধ্বংসাবশেষ তুলে আনার গিনেজ রেকর্ডধারী ঘটনাটি ২০১৯ সালের। ওই বছর মে মাসে ফিলিপাইন সাগরের প্রায় সাড়ে এগার হাজার ফুট গভীর থেকে মার্কিন নেভির একটি পরিবহণ উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ তুলে আনা হয়। যদি উড়োজাহাজটি উদ্ধার করা না যেত, তাহলে বেইজিংয়ের হাতে পড়ে ঠেকাতে উড়োজাহাজটি ধ্বংস করে ফেলতে হতো।
‘সবচেয়ে সহজ হতো—যদি এটাকে লক্ষ্য করে টর্পেডো ছোঁড়া যেত’—সে সময় এমনটাই বলেছিলেন এক সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, সে সহজ পথে হাঁটতে চায়নি মার্কিন নেভি।