কে এই ইব্রাহিম রাইসি?
গতকাল রোববার (১৯ মে) ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার দেশটির পূর্ব-আজারবাইজান প্রদেশে দুর্ঘটনার কবলে পড়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক মহলে আবারও গুঞ্জন, কে এই ইব্রাহিম রাইসি?
এদিকে আজ সোমবার (২০ মে) রয়টার্সের এক খবরে জানানো হয় ওই দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহিয়ানসহ হেলিকপ্টারের নয়জন আরোহীর সবাই নিহত হয়েছেন।
হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইরানের অবস্থান বিশ্ব দরবারে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। গত ১৯ এপ্রিল ইরান ইসরায়েলে হামলা করার পর থেকে ইরানের পাশাপাশি ইব্রাহিম রাইসির নাম বিশ্ব মিডিয়াতে আবারও ছড়িয়ে পড়ে।
ইব্রাহিম রাইসিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আল খামেনির উত্তরসূরী হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। ৬৩ বছর বয়সী এই নেতাকে রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে পার করতে হয়েছে। তিনি কোনো উপন্যাসের নায়ক হয়ে নিজের অবস্থানে আসেননি, অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাকে আসতে হয়েছে বর্তমান অবস্থানে।
অনেকে তাকে কট্টরপন্থি ইসলামি নেতাও বলতেন। তবে রক্ষণশীল হলেও ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা করার পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি দেশটির অষ্টম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ২০২১ সালের ৩ই আগস্ট।
ইব্রাহিম রাইসি ১৫ বছর বয়সে ইরানের বিখ্যাত কোম ধর্মীয় শিক্ষালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন এবং সেই সময়ের বেশ কয়েকজন শীর্ষ আলেমের সংস্পর্শে আসেন। ২০ দশকের গোড়ার দিকে তিনি ইরানের বিভিন্ন শহরের প্রসিকিউটর নিযুক্ত হন। ১৯৮৫ সালে রাইসি রাজধানী তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান।
১৯৮৩ সালে তিনি মাশহাদের মসজিদের ইমাম আহমদ আলামোলহুদার মেয়ে জামিলেহ আলামোলহুদাকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে।
১৯৮৮ সালে ইরানের রাজনৈতিক বন্দীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সাথে জড়িত চারজন বিচারপতির পাশাপাশি একজন ছিলেন রাইসি। এ ঘটনার পর থেকে তিনি ইরানের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বেশ অপ্রিয় হয়ে উঠেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার এই ঘটনাকে ইরানের ইতিহাসে রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
১৯৮৯ সালে ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর তিনি তেহরানের প্রসিকিউটর নিযুক্ত হন।
রাইসি এখানে থেমে থাকেননি, ২০১৬ সালের ৭ই মার্চ মাশহাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আস্তান কুদস রাজাভির চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করেন।
রাইসি ২০১৭ সালে হাসান রুহানির বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
সে নির্বাচনে পরাজয়ের পর, রাইসি তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন। ২০২১ সালের জুনে, তিনি ৬২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডন্টে নির্বাচিত হন।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপ করার পরে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (জেসিপিও) ভেঙে পড়েছিল, যা ইরানের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছিল। যা রাইসিকে কঠিন পরীক্ষা সম্মুখীন করেছিল।
রাইসি খামেনির সাথে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন শাখা যেমন সামরিক ও আইন প্রণয়নকারী বিভাগ এবং শক্তিশালী নির্বাহি বিভাগের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখেন।
সমালোচকরা বলেন, রাইসি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলির চেয়ে প্রতিরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে জীবনযাত্রার অবনতির মাঝেও জনসাধারণের ক্ষোভ ও সমলোচনার সময়ও ইরানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন শক্ত হাতে।
রাইসির শাসনাধীন সময়ে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ দেখা দেয় ২০২২ সালের শেষের দিকে। বাধ্যতামূলক হিজাব পরার নিয়ম না মানার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় মাহসা আমিনি নামের এক তরুণীকে। পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মাহসা আমিনির মৃত্যু হলে জনসাধারণের ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভ কয়েক মাস ধরে ইরানকে কাঁপিয়ে রেখেছিল, প্রতিবাদে নারীরা তাদের হিজাব খুলে এবং চুল কেটে প্রতিবাদ জানান। এই বিক্ষোভের ঘটনায় ৫০০ জন নিহত হয়। এছাড়া সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
বিক্ষোভ চলার সময় দেশ অচল হয়ে পড়লেও শক্ত হাতে ইরানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাইসি। ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ে নিজেদের শক্ত ভূমিকা রেখেছে। গাজা যুদ্ধ চলার সময় রাইসি হুঁশিয়ারি দিয়ে ইসরায়েলে হামলা চালান। অন্য কোনো মুসলিম রাষ্ট্র এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেনি।