আইনগত অবস্থান থেকে দুদকের আরও কঠোর হওয়া উচিত : হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ
আইনে বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান বা তদন্ত শেষ করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ‘ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ’ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলছেন, দেশের দুর্নীতি চর্চা বন্ধ করতে আইনগত অবস্থান থেকে কমিশনের আরও কঠোর হওয়া উচিত।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চের প্রকাশিত রায়ে এ পর্যবেক্ষণ এসেছে।
দুদকের মামলায় অব্যাহতি চেয়ে এক আসামির আবেদন বাতিলের মামলায় ৭২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্ট তাঁর রায়ে বিশেষ বিধান (আইনে) থাকার পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান, তদন্ত শেষ না করায় সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান বা তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলেও হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, দুদক আইনের ৩২ ধারা ও বিধি ১৫ অনুযায়ী কমিশনের উচিত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় আনা এবং দক্ষতার সঙ্গে বিচার কাজ শেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই দুর্নীতি এবং দুর্নীতি চর্চা নির্মূল হবে।
রায়ে আরও বলা হয়, যদি কমিশনের কোনো কাজ, আদেশ, কার্যপ্রণালী ও নিষ্ক্রিয়তা সংশ্লিষ্ট আইনের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে এবং দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশন যদি যথাযথ ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে নীরবতা অবলম্বন করে, তবে সব প্রচেষ্টাই ব্যাহত হবে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘আজকাল আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, বড় বড় দুর্নীতির মামলাগুলোর আইনি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আত্মসাতের টাকা পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত। এর ফলে অভিযুক্তরা নিজেদের রক্ষায় সুবিধা পাচ্ছে বা সুবিধা নিচ্ছে। টাকা উদ্ধার দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ নয়। আইনেও সে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। টাকা পুনরুদ্ধারে শুধু এটুকু প্রতীয়মান হয় যে, অভিযুক্ত বা ব্যক্তি অর্থ আত্মসাৎ বা পাচার করেছেন।’
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট আরও বলেন, “আমরা লক্ষ করেছি যে, দুর্নীতি করে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অনেক সরকারি দপ্তরের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে। কিন্তু সে মামলাগুলোর অনুসন্ধান, তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার জন্য ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ দুদক নেয়নি। তা ছাড়া এ ব্যাপারে কমিশনের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে প্রশ্ন ওঠে, কমিশন কি আইনের ঊর্ধ্বে? নিশ্চিতভাবে এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিধি, ২০০৭ এ কমিশনের কার্যক্রম বিশদভাবে বর্ণনা করা আছে। ফলে দেশের দুর্নীতি চর্চা বন্ধ করতে আইনগত অবস্থান থেকে কমিশনের উচিত আরও কঠোর হওয়া। তবে, আইন এবং বিধির বাইরে গিয়ে অন্য কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়নি।’
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, কুড়িগ্রাম পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মমিনুর রহমান ও সহকারী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলামকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ২০১১ সালের ২৬ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়। দুদকের রংপুরের জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ওই দিনই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ৬ মে মো. জহিরুল ইসলাম মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন। শুনানির পর একই বছরের ১২ জুন রংপুরের বিশেষ জজ আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেন।
পরে ওই আদেশের বিরুদ্ধে দুদক হাইকোর্টে একটি আবেদন (রিভিশন পিটিশন) করে। সে আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। হাইকোর্ট তার রুলে জহিরুল ইসলামকে দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশ কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চান। এরপর চূড়ান্ত শুনানির পর রুলটি যথাযথ ঘোষণা করে গত ২৪ জানুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট।