আগরতলা মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু
১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে; যা ইতিহাসে ‘আগরতলা মামলা’ বা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে সুপরিচিত। সরকারি নথিতে অবশ্য এর নাম ভিন্ন ছিল। এর নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ মামলা।
সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলে করা এই মামলা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য স্বাধীনতাকামী বাঙালি অফিসারদের ‘শায়েস্তা’ করার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মামলাই হয়ে উঠে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পথের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর পথ ধরেই আসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। আর বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছিল, শেখ মুজিবুর রহমানসহ এই কর্মকর্তারা ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। এতে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করা হয় এবং তাঁকে এই ষড়যন্ত্রের ‘মূলহোতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বস্তুত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি দায়ের করার সময় শেখ মুজিবুর রহমান অন্য একটি মামলায় আটক ছিলেন।
এই মামলার আসামিরা হলেন- শেখ মুজিবুর রহমান, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ, সিডিআই নূর মোহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফুজ উল্লাহ, প্রাক্তন করপোরাল আবুল বাশার, মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক, ভূপতি ভুষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, প্রাক্তন হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. আবদুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, মো. খুরশীদ, খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান সিএসপি, হাবিলদার আজিজুল হক, মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শামসুল হক, শামসুল আলম এএমসি, ক্যাপ্টেন মো. আবদুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী মিয়া, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা এএমসি, ক্যাপ্টেন এ. এন. এম নুরুজ্জামান, সার্জেন্ট আবদুল জলিল, মো. মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট এস এম এম রহমান, প্রাক্তন সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ এএমসি এবং কমান্ডার আবদুর রউফ।
বিচার প্রক্রিয়া
১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি দুজন সিএসপি অফিসারসহ ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের গ্রেপ্তার সম্পর্কে সরকারি প্রেসনোটে দাবি করা হয়েছিল, ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের উদঘাটিত স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই বছরের ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশ রক্ষা আইনের একটি মামলা থেকে মুক্তি দিয়ে আবার গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। এরপরে ৩৫ জনকে আসামি করে সরকারপক্ষ মামলা করে।
একই বছরের ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে অভিযুক্ত আসামিদের বিচারকাজ শুরু হয়। এতে অভিযোগপত্র দাখিল করে বলা হয়, আসামিরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন। এই মামলার আসামিরা তখন ছিলেন মৃত্যুর মুখে। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান অভয় দিয়ে তাঁদের বলতেন, ভয়ের কিছু নেই। এই মামলা টিকবে না। সবাই নির্দোষ প্রমাণিত হবে এবং মুক্তি পাবেন।
ব্রিটিশ আইনজীবী নিয়োগ
এই মামলার আসামিদের পক্ষে আইনি সহায়তা নিয়ে কাজ করেছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। তিনি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি পড়ালেখা শেষে ১৯৬৭ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসি। দেশে এসেই প্র্যাকটিস শুরু করার পর প্রথম যে মামলাটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হই তা ছিল ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। পাকিস্তান সরকার তখনও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পূর্ব বিবরণী প্রকাশ করেনি। সময়টা ছিল ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাস। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এই ৩৫ জন একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। সেই থেকে মামলাটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে আখ্যায়িত হয়। তখন থেকেই আমি এই মামলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হই। আমরা ধারণা করেছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমানসহ সবাইকে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিচারে তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হলে ফাঁসি দেওয়া হবে।’
মওদুদ আহমদ আরও বলেন, ‘ওকালতনামা পাওয়ার পর আমি লন্ডনে প্রবাসী ও বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। একপর্যায়ে আমরা বার্নাড সেরিডন বলে এক সলিসিটর ফার্মের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপিকে সম্মত করালাম, যিনি এ ধরনের মামলা পরিচালানায় অভিজ্ঞ ছিলেন। গোপনে কিছু অর্থও তাঁর জন্য বিদেশে পাঠালাম। মোল্লা জালালউদ্দিন ও সাবেক রাষ্ট্রদূত শামসুল হক এবং আমি মিলে চট্টগ্রাম থেকে এই টাকা পাঠালাম। ওই সময়ে হাইকোর্টের নামকরা আইনজীবী ছিলেন আব্দুস সালাম। তাঁর নেতৃত্বে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনার জন্য ১৯৬৭ সালে ডিফেন্স টিম গঠন করা হলো। জুন মাস নাগাদ আমার সিনিয়র টমাস উইলিয়ামস ঢাকায় এলেন। এ ধরনের মামলা যে সাংবিধানিকভাবে চলতে পারে না, সেই আবেদন জানিয়ে রিট পিটিশন দাখিল করা হলো। সেই রিট আবেদনের শুনানি হলো পুরোনো হাইকোর্ট ভবনে। প্রধান বিচারপতি ছিলেন বি এ সিদ্দিকী। টমাস উইলিয়ামস সপ্তাহ দুয়েক ঢাকায় ছিলেন। তাঁর আগমন ও মামলা পরিচালনার কারণে এই ষড়যন্ত্র মামলা ব্যাপক প্রচার লাভ করে এবং এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। মামলার প্রতিদিনের বিচারিক কার্যক্রম খবরের কাগজে বিস্তারিত প্রকাশ পাওয়ায় স্বাধীকার আন্দোলনের পক্ষে জনমত আরও ব্যাপকতা লাভ করে।’
১১ মাস ধরে মামলা চলার পর ১৯৬৯ সালে গণ-অভুত্থানের মুখে আইয়ুব খান এই মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
মামলা প্রত্যাহার
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্যবাদী মনোভাব শুরু থেকেই ছিল। বাঙালিরা ছিল শোষিত ও নির্যাতিত। এই শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে। এর আগে ১৯৬৬ সালেই শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করেন; যা বাঙালির মুক্তি সনদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
আগরতলা মামলার বিচারকাজ চলার সময় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বাঙালির আস্থা আরও বৃদ্ধি পায়, স্বাধীনতাকামী বাঙালি তাদের নেতার বিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সারা দেশে হরতাল, অবরোধের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতি গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা কারফিউ ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে।
এর মধ্যে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে এই মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই খবর বাইরে এলে সারা দেশে আন্দোলনের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আসাদ, নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর শামসুজ্জোহার মতো মুক্তিকামী বাঙালিদের হত্যার ঘটনায় গোটা পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠে। এই গণআন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা আইয়ুব সরকারের ছিল না। একপর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আইয়ুব সরকার দেশে আসন্ন একটি গৃহযুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা হিসেবে মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
মামলাটির শেষ শুনানির তারিখ ছিল ১৯৬৯ সালের ৬ জানুয়ারি। এই মামলার জবানবন্দিতে শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা মামলাকে সরকারের হীন ষড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যা আখ্যা দেন। এই মামলার আসামিদের ওপর বর্বর নির্যাতনেরও তিনি প্রতিবাদ জানান।
সবশেষ ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলার সব আসামিকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরের দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি, ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং এই সমাবেশ থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।