আ.লীগ থেকে পাপিয়াদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে : আবদুর রহমান
আওয়ামী লীগে পাপিয়াদের দরকার নেই, এ দল থেকে পাপিয়াদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
দলের উপস্থিত নেতাদের উদ্দেশে আবদুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ থেকে পাপিয়াদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে। এটা সব নেতাকর্মীকে মনে রাখতে হবে। সেই প্রস্তুতি নিয়ে আপনাদের এগোতে হবে। এই সংগঠনে এদের কোনো দরকার নেই।’
পাংশা সরকারি কলেজ মাঠে এ কে এম শফিকুল মোর্শেদ আরুজের সভাপতিত্বে কাউন্সিলে আরো বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সংসদ সদস্য মির্জা আজম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. জিল্লুল হাকিম, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কাজী এরাদত আলী, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট খোদেজা নাসরিনসহ পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
প্রথম অধিবেশনের আলোচনা শেষে পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে খন্দকার সাইফুল ইসলামকে সভাপতি ও এ এফ এম শফিউদ্দিন পাতাকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়।
এদিকে গতকাল বিকেলে রাজধানীর বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের করা পৃথক তিন মামলায় নরসিংদীর যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া ও তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরীকে পৃথক তিন মামলায় পাঁচ দিন করে মোট ১৫ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। অন্যদিকে তাঁদের সহযোগী সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবা নূরকে বিমানবন্দর থানার জাল টাকার মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
সোমবার বিকেলে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ উর রহমান ও মোহাম্মদ জসিম এ আদেশ দেন। এর আগে গতকাল দুপুরে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শামীমা নূর পাপিয়াসহ চার আসামিকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এর পরে বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দ্বিতীয় তলায় ২৮ নম্বর আদালতে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তোলা হয়।
এ সময় পাপিয়াকে একঝলক দেখার জন্য আইনজীবী, পুলিশ, বিচারপ্রার্থী ও আদালতের কর্মচারীরা এজলাসে আসেন। কিন্তু পাপিয়াকে লোহাবেষ্টিত কাঠগড়ায় প্রবেশদ্বারে চেয়ারে বসিয়ে আড়াল করে রাখেন অপর আসামি শেখ তায়্যিবা। পরে বিচারক এজলাসে এলে পাপিয়াসহ চার আসামিকে কাঠগড়ায় ওঠানো হয়।
প্রথমে বিমানবন্দর থানায় করা বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় (জাল টাকা) ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের ওপর শুনানি হয়। এ মামলায় চার আসামির ১০ দিন করে রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কায়কোবাদ কাজী। রাষ্ট্রপক্ষে তাপস কুমার পাল, আজাদ রহমান ও হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে তাপস কুমার পাল বলেন, ‘এ আসামির কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই। তারপরও কোটি কোটি টাকার মালিক। বিভিন্ন মেয়েকে নিয়ে জোরপূর্বক নির্যাতন করাতেন। এ ছাড়া তিনি হোটেল ওয়েস্টিনে প্রেসিডেন্ট স্যুটে কোটি টাকার ওপরে বিল দিয়েছেন। এ সবকিছুর উৎস জানা ও অন্য আসামিদের খুঁজে বের করতে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।’
অন্যদিকে পাপিয়াদের পক্ষে আইনজীবী ইলতুৎমিশ সওদাগর, কলিম মৃধা, কামাল হোসেন ও আতিকুর রহমান রিমান্ড বাতিল করে জামিনের আবেদন করে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত আসামিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার নির্দেশ আছে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পর তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে, আইনবহির্ভূতভাবে তাদের রেখে দিয়েছে। তাদের নির্যাতন করেছে। আর রিমান্ডে নেওয়ার কী আছে?’
আইনজীবীরা বলেন, ‘মাননীয় আদালত, বলা হচ্ছে মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা করার কথা। কোনো মেয়ে তো অভিযোগ করেননি। এসব নাটক ছাড়া আর কিছু না। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁদের মামলায় জড়ানো হয়েছে। আসামিদের রিমান্ড বাতিল করে জামিন প্রার্থনা করছি।’
পুলিশ ও র্যাব বলছে, আসামিদের সঙ্গে নিয়ে তাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু আসামিরা বলছে, তাদের বাসায় নেওয়া হয়নি। আর যা উদ্ধার করার, তা তো উদ্ধার হয়ে গেছে। রিমান্ডে নিলে আর কোনো অগ্রগতি হবে না। মূলত রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে তাঁদের মামলায় জড়ানো হয়েছে। রিমান্ড বাতিল করে তাঁদের জামিনের প্রার্থনা করছি।
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ উর রহমান জামিন নামঞ্জুর করে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
এরপর শেরেবাংলা নগর থানার দুই মামলার বিষয়ে শুনানি হয়। এ দুই মামলায় পাপিয়া ও তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান আসামি। মামলা দুটি দায়ের করেন র্যাব-১-এর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার শফিকুল ইসলাম।
এ দুই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার এসআই সুধাংশু সরকার এ দুই আসামিকে গ্রেপ্তার দেখানোসহ ১০ দিন করে ২০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন।
প্রথমে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিনুর রহমান তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন। এরপর অন্য দুই মামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিমের আদালতে রিমান্ড শুনানি হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ২০ দিনেরই রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করা হয়।
গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে নয়াদিল্লি যাওয়ার সময় বহির্গমন গেট থেকে পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান (৩৮) ও ব্যক্তিগত সহকারী সাব্বির খন্দকারকে (২৯) গ্রেপ্তার করা হয়। এর পরে তাঁদের তথ্যমতে, হোটেল ওয়েস্টিন থেকে পাপিয়া ও তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী শেখ তায়্যিবাকে (২২) গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বিষয়ে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল শনিবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে জানান, হোটেল ওয়েস্টিনের ২১ তলার প্রেসিডেন্ট কক্ষটি গত নভেম্বরে ভাড়া নেন পাপিয়া। তিনি গত তিন মাসে ওই কক্ষের ভাড়া পরিশোধ করেছেন প্রায় ৮৮ লাখ টাকা। ১৯ তলায় একটি বার রয়েছে, যেটি তিনি পুরোটাই বুক করে নিতেন। সেখানে প্রতিদিন তিনি আড়াই লাখ টাকা মদের বিল পরিশোধ করতেন। সব মিলিয়ে দেখা যায়, গত তিন মাসে তিনি প্রায় তিন কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছেন হোটেল কর্তৃপক্ষকে।
র্যাব-১-এর অধিনায়ক বলেন, “পাপিয়ার আয়কর ফাইল তলব করে দেখা গেছে, সেখানে তিনি বছরে ২২ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। অথচ তাঁর প্রতিদিন বারের বিলই আসে আড়াই লাখ টাকা। এত টাকার উৎস কোথায়? জানতে চাইলে পাপিয়া র্যাবকে জানিয়েছেন, যাঁরা হোটেলে আসতেন, তাঁদের কাছে মেয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এরপর অশ্লীল ভিডিও তুলে ওই সব ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হতো। লোকলজ্জার ভয়ে কেউ মুখ খুলত না। এ রকম সাতজন উঠতি বয়সী তরুণীর সঙ্গে র্যাবের কথা বলা সম্ভব হয়েছে। যাঁদের মাসে ৩০ হাজার টাকা করে দিতেন পাপিয়া। বিনিময়ে তাঁদের ব্যবহার করা হতো। কেউ রাজি না হলে তাঁদের লাঠি দিয়ে পেটাতেন পাপিয়া। আবার কোনো কোনো মেয়ের আপত্তিকর ছবি ‘বড়লোক কাস্টমারদের’ মুঠোফোনে পাঠিয়ে দিয়ে আগ্রহ তৈরি করতেন। এরপর ওই লোকগুলো এলে তাঁদের জিম্মি করা হতো।”
শাফী উল্লাহ বুলবুল আরো বলেন, “পাপিয়া পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তেজগাঁও এফডিসি গেটসংলগ্ন এলাকায় অংশীদারত্বে তাঁর একটি ‘কার এক্সচেঞ্জ’ নামক গাড়ির শোরুম আছে। এ ছাড়া নরসিংদী জেলায় তাঁর ‘কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সলিউশন’ নামে একটি গাড়ি সার্ভিসিং সেন্টার আছে। এসব ব্যবসার আড়ালে তিনি অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তিনি সমাজসেবার নামে নরসিংদী এলাকায় অসহায় নারীদের আর্থিক সহযোগিতার নামে তাঁদের অনৈতিক কাজে লিপ্ত করতেন। বছরের অধিকাংশ সময় তিনি নরসিংদী ও রাজধানীর বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করেন। নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজির জন্য তাঁর একটি ক্যাডার বাহিনী আছে। এ ছাড়া তাঁর স্বামীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি নরসিংদী ও ঢাকায় একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন। গ্রেপ্তারের সময় তাঁদের কাছ থেকে জাল টাকা, ডলারসহ প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।”
পরদিন রোববার দুপুরে পাপিয়ার ফার্মগেটের বাসা থেকে অস্ত্র, মদসহ বিপুল অবৈধ টাকা উদ্ধার করে র্যাব। পরে বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, ‘দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেটে পাপিয়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ২০টি পিস্তলের গুলি, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ ও নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘রাজধানীর গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে সব সময় বুক করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাপিয়া। যিনি হোটেলটির বারে বিলবাবদ প্রতিদিন পরিশোধ করতেন আড়াই লাখ টাকা। এ ছাড়া নারীদের দিয়ে অবৈধ কাজ করাতেন। যাদের মাসিক আট হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হতো। এ ছাড়া পাপিয়ার কথা কেউ না শুনলে তাদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে নির্যাতন করা হতো।’