আসামিদের মধ্যে ৬ শিশু ভয়ংকর প্রকৃতির দুর্ধর্ষ
বরগুনার বহুল আলোচিত মো. শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ (২৬) হত্যা মামলায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ কিশোরের রায়ে আদালত বলেছেন, ‘শিশু আসামিদের মধ্যে ছয়জন শিশু ভয়ংকর প্রকৃতির দুর্ধর্ষ। তাদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে শিশু আইনের বিধানমতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল।’
পরে অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ কিশোরের রায় ঘোষণা করেন আদালত। আসামিদের মধ্যে ছয়জনকে ১০ বছর করে, চারজনকে পাঁচ বছর করে আর একজনকে তিন বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। খালাস দেওয়া হয়েছে তিনজনকে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে বরগুনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. হাফিজুর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ের মূল সাত পৃষ্ঠা এনটিভি অনলাইনের হাতে এসেছে।
রায়ে বিচারক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, রিফাত শরীফ হত্যা মামলাটি বরগুনা জেলাসহ সমগ্র বাংলাদেশের একটি বহুল ন্যক্কারজনক ঘটনা। হতভাগ্য রিফাত শরীফ তারই বন্ধু ১ নম্বর আসামি নয়ন বন্ড ও তার সহযোগী রিফাত ফরাজী, রিশান গং কতিপয় সন্ত্রাসীর হাতে খুন হয় যাদের অধিকাংশই আইনের ভাষায় শিশু। প্রকাশ্য দিবালোকে বরগুনার সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বরগুনা সরকারি কলেজের গেটের সামনে রাস্তায় যার দুই পাশে আরো কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে নির্মমভাবে খুন হয়। পাশেই কতগুলো কিশোর এই হত্যাকাণ্ডে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে নির্বিঘ্নে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করার জন্য সাহায্য করেছে। তারা চারদিকে ঘেরাও করে রাখে। প্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তেই এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে। টিভি সংবাদের মাধ্যমেও এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও দেখে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত ও হতবাক হয়ে যায়।
রায়ে বলা হয়, যে শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ এবং আগামীর নির্মাতা, তাদের দ্বারা আলোচিত এই হত্যাকাণ্ড নির্মমতার ভীতি তৈরি হবে; সচেতন মহল, সুশীল সমাজ ও সাধারণ জনগণ তা প্রত্যাশা করে না। তাই শিশু আইনে লঘু শাস্তি ও অধিকারের সুযোগ নিয়ে কিছু বিপথগামী শিশু যেন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাই তো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। জনপ্রিয় জাতীয় একটি দৈনিকের সাম্প্রতিক লিড নিউজ হয় ‘আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং’।
বিচারক বলেন, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের তাই প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্তিই একমাত্র কাম্য। কেননা, প্রযুক্তির কল্যাণে দেশব্যাপী নির্মম এই হত্যাকাণ্ডটি লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোরের মধ্যে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা দ্বিগুণ উৎসাহ বেড়ে যাবে। যার নমুনা আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। গত ঈদুল ফিতরের দিন বিকেল বেলায় বরগুনা থানার গোলবুনিয়া এলাকায় হৃদয় নামে ১৫ বছরের একটি শিশু একদল শিশু-কিশোরের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছে। তবে কোনো নিরাপরাধ শিশু যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হয় কিংবা তার কৃত অপরাধের বেশি সাজা না হয় তার দিকেও ট্রাইব্যুনাল সতর্ক বিচারকার্য সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছে।
রায়ে বলা হয়, অত্র মামলার বিচারাধীন শিশুসহ কোনো শিশুই অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না। সামাজিক পরিস্থিতি, অসৎ সঙ্গ, নৈতিক শিক্ষার অভাব; সর্বোপরি অভিভাবকদের সঠিক পরিচালনার অভাবে সমাজের কিছু কিছু শিশু বিপদগামী হয়। শিশুরা অপরাধী হওয়ার পেছনে তাদের নিজস্ব দায় থাকে না। তারপরও অপরাধের দায়ভার তাদেরকেই বহন করতে হয়। অথচ এই শিশুদের যথাযথ শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়া গেলে এবং তাদের সঠিকভাবে প্রকৃত মানুষ হওয়ার পরিবেশ দিতে পারলে আজকের এই শিশুরাসহ কোনো শিশুই বিপথগামী হতো না। নিহত নয়নবন্ড ও ইতোপূর্বে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজীর নামে পাঁচ-ছয়টি করে মামলা বিচারধীন রয়েছে। বরগুনা এলাকায় নয়নবন্ড ও রিফাত ফরাজী এলাকায় মাদকসেবী এবং সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। এই দুজনের নিয়ন্ত্রণাধীন ও দলীয় গ্রুপের সদস্য এবং সহযোগী ছিল এসব শিশু আসামি। তাদের সংসর্গে থেকে এই শিশু অপরাধীরা বিপথগামী হয়েছে। শিশু আসামিদের মধ্যে ছয়জন শিশু ভয়ংকর প্রকৃতির দুর্ধর্ষ। তাদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে শিশু আইনের বিধানমতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
আজ দুপুর ১টা ১০ মিনিটে রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। শেষ হয় ২টা ৪০ মিনিটে।
এর আগে সকালে অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ কিশোর আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। আসামিদের মধ্যে আট কিশোর জামিনে থেকে নিজেরাই আদালতে হাজির হয়। অপর ছয় আসামিকে প্রিজনভ্যানে করে পুলিশ কারাগার থেকে হাজির করে।
রায়কে ঘিরে সকাল থেকে বরগুনা জেলা দায়রা আদালত প্রাঙ্গণে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে কয়েক স্তরে নিরাপত্তা নেওয়া হয়।
গত বছরের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাত শরীফকে। এ ঘটনায় দুই ভাগে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম ভাগে সম্পন্ন হয় প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিচার। দ্বিতীয় ভাগে অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিচার হয়।