উত্তেজনা-শঙ্কার দ্বিতীয় ধাপের ভোট আজ
সহিংসতার আশঙ্কার মধ্যেই আজ বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৫ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আজ বৃহস্পতিবার। এ ভোট নিয়ে একদিকে রয়েছে উত্তেজনা। অন্যদিকে রয়েছে অজানা শঙ্কা।
তবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট আয়োজনে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আজ সকাল ৮টা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এ ভোটগ্রহণ চলবে। ভোট নিয়ে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে সব নির্বাচনি এলাকায়।
ভোট কেন্দ্রে যেতে ভয় পাচ্ছেন সাধারণ ভোটাররা এমন অভিযোগ প্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে। যদিও, সহিংসতার ঘটনায় ‘অস্বস্তি’ ও ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কঠোর পদক্ষেপে নেওয়ার কথা বলছে।
এই ধাপের নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় বাধ্য হয়ে ১০ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের মতে, এবারের ইউপি নির্বাচনে ইসির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নির্বাচন কমিশন অনেকটা অসহায়।
এদিকে ঘরে ঘরে বা পাড়া-মহল্লায় পাহারা দিয়ে নির্বাচনি সহিংসতা ঠেকানো সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। বুধবার কমিশন সভা শেষে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনার প্রেক্ষাপটে সিইসি এমন মন্তব্য করলেন।
নরসিংদীসহ কয়েকটি এলাকায় সংঘাতের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘এ জাতীয় ঘটনা এভাবে পাহারা দিয়েও ঠেকানো যায় না, বাস্তবতা হলো এটা। ঘরে ঘরে, মহল্লায় মহল্লায় পুলিশ দিয়ে পাহারা দিয়ে এ জাতীয় অপ্রীতিকর ঘটনা থামানো যায় না। এর একমাত্র উপায় হলো নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহনশীলতা। নির্বাচনসুলভ আচরণ করতে হবে।’
অন্যদিকে স্থানীয় নির্বাচনে উত্তেজনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করে সিইসি বলেন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর হবে বলে ইসি আশা প্রকাশ করে। নির্বাচনী সহিংসতা দমন করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসি জানিয়েছে, দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮ ইউপিতে ভোটের তফসিল ঘোষণা করা হলেও আজ ভোটগ্রহণ হবে ৮৩৫ ইউপিতে। কেননা ৫ ইউপিতে সব পদে জনপ্রতিনিধিরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিবাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া সাত ইউপিতে ভোট স্থগিত করেছে ইসি এবং ১ ইউপির ভোট বাতিল করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে মোট ভোটকেন্দ্র হচ্ছে আট হাজার ৪৯২টি। মোট ভোটার হচ্ছে এক কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ২২৬ জন। এর মধ্যে এ ধাপে ১৬ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন।
ইসি সূত্র বলছে, ৮৩৫ ইউপিতে চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছেন তিন হাজার ৩১০ জন, সংরক্ষিত নারী প্রার্থী নয় হাজার ১৬১ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ডে প্রার্থী রয়েছেন ২৮ হাজার ৭৪৭ জন। এ নির্বাচনে মোট ৪১ হাজার ২১৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২০টি ইউপিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এবং বাকিগুলোতে প্রচলিত ব্যালট পেপারে ভোট হবে। নির্বাচন উপলক্ষে বুধবার সব ভোট কেন্দ্রে নির্বাচনি সরঞ্জাম পৌঁছানো হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে র্যাব, পুলিশ ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনি এলাকায় টহল শুরু করেছেন। তারা থাকবেন ভোটের পরের দিন পর্যন্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে রয়েছেন নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।
জানা গেছে, এ নির্বাচনে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ইসি। স্থানীয় পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় ওসিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নির্বাচন কমিশন। বুধবার অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় একজন নির্বাচন কমিশনার ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, থানার ওসিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ওসিরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করছেন। পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে র্যাব-বিজিবি লাগে না।
এদিকে উদ্বিগ্ন নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১০ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করেছে। বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসনের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, মাদারীপুরসহ ১০টি জেলায় নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন থাকবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় অতিরিক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৮১টি চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী
দ্বিতীয়ধাপের ভোটে ১৮ জেলার ২৮ উপজেলায় ৮১ জন ইউপি চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী হওয়ায় তারা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। এ ছাড়াও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৭৬ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ২০৩ জন নির্বাচিত হয়েছেন। বিনাভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের মধ্যে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় পাঁচজন, ভোলার দৌলতখানে একজন, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে একজন, নারায়ণগঞ্জ সদরে দুইজন, রূপগঞ্জে তিনজন, শেরপুর সদরে তিনজন, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে তিনজন, জামালপুর সদরে পাঁচজন, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে তিনজন, কুমিল্লার লাকসামে পাঁচজন, তিতাসে একজন ও মেঘনায় একজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হয়েছেন।
একইভাবে চাঁদপুর সদরে দুইজন, ফেনীর ফুলগাজীতে তিনজন, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে একজন, মাদারীপুরের কালকিনিতে একজন, শরীয়তপুর সদরে তিনজন, খুলনা সদরে একজন, মাগুরা সদরে তিনজন, যশোরের চৌগাছায় দুইজন, বাগেরহাট সদরে তিনজন, মোল্লাহাটে একজন, জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে একজন, সিরাজগঞ্জ সদরে তিনজন, রায়গঞ্জে তিনজন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পাঁচজন, মিরসরাইয়ে ১৩ জন ও ফটিকছড়ি উপজেলায় তিনজন বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন।
মাঠ প্রশাসনেরও সহিংসতার আশঙ্কা
ইউপি ভোটের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বিগ্ন নির্বাচন কমিশন গত ৪ নভেম্বর সারা দেশের মাঠ পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করে। ওই বৈঠক থেকে আলোচনা সভায় পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনার তাঁদের বক্তব্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সেই আশঙ্কার পর সাতজনের প্রাণহানি হয়। এর মধ্যে নরসিংদীতে চারজন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একজন ও মেহেরপুর দুইজন। এ পর্যন্ত ইউপি ভোটে ৩০ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
ইসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলায়-জেলায় অস্ত্রের ঝনঝনানিও বেড়ে চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটছে। নির্বাচনে অন্য দলের কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে কার্যত ক্ষমতাসীনরাই প্রভাব বিস্তার করছে। ভোটে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই। ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বেকায়দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
উল্লেখ্য, সারা দেশে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ২১ জুন ২০৪ ইউপি ও ২০ সেপ্টেম্বর ১৬০ ইউপির ভোট হয়। দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৫ ইউপির ভোট আজ। তৃতীয় ধাপে এক হাজার ৩ ইউপির ভোট হবে ২৮ নভেম্বর। চতুর্থ ধাপের ৮৪০ ইউপিতে ভোট ২৩ ডিসেম্বর।