এক দশক ধরে বাংলায় রায় লিখছেন যে দুই বিচারপতি
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশপ্রেম থেকে ১৩ বছর ধরে বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন। আইনজীবী রাষ্ট্রপক্ষের মামলার আর্জি দাখিল শুনানি ইংরেজিতে লিখলেও বিচারপতি রায় লিখে যাচ্ছেন বাংলায়। ২০১০ সালে অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এবং পরে স্থায়ী হয়েও টানা ১৩ বছরে কোনো রায় ইংরেজিতে লেখেননি, যা বিচার বিভাগে নজিরবিহীন ঘটনা বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।
একইভাবে, অপর একজন বিচারপতি গত ১০ বছরে সব রায় বাংলায় লিখে চলেছেন। তিনি হলেন বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী। তিনি ২০১২ সালে বিচারপতি হিসেবে স্থায়ী হওয়ার পর থেকে বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সূত্রে জানা যায়, হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পান। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তিনি বাংলা ভাষায় রায় লিখে চলেছেন। ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজারের বেশি রায় বাংলায় লিখেছেন। এ ছাড়া বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ২০১২ সালে স্থায়ী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন। বাংলায় এ রায়ের ফলে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ স্বস্তিবোধ করছে।
এ বিষয়ে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি শপথ নেওয়ার পর থেকে কখনও ইংরেজিতে রায় লিখিনি। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল দুই বছরের জন্য অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর আমাকে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ও আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো। সেখানে আমি বলেছি, আমি বাংলায় শপথ নিয়েছি; বাংলা রায় লিখে যাব। প্রথম রায় যখন বাংলায় লিখলাম, তখন আমাকে অনেকে তিরস্কার করেছিলেন। কিন্তু, আমি থেমে যাইনি। এখন তাঁরাই আমাকে উৎসাহ দিচ্ছেন।’
বাংলায় রায় লেখার উৎসাহ পাওয়ার বিষয়ে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ফৌজদারি কার্যবিধি বিবিধ মামলা নম্বর ২০৮৫৯/২০১০ এ রায়ে বলেন, “বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে দেওয়া বাংলা একাডেমির উদ্বোধনী ভাষণ আজও জাতিকে চরমভাবে নাড়া দেয়। সেদিন তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন : ‘আমি ঘোষণা করছি—আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’”
বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন চাঁদপুরের নৌকাডুবিতে প্রায় ৩০০ জনের প্রাণহানির ঘটনায় বাংলায় রায় দিয়েছেন। যে মামলায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ইংরেজিতে শুনানি করেছেন।
অপরদিকে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকীর দেওয়া ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। সে রায়ের ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠা বাংলায় লিখেছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী।
সম্প্রতি একটি সেমিনারে পিলখানা হত্যা মামলার রায়টি কেন বাংলায় লিখেছেন, তা ব্যক্ত করে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী বলেন, ‘পিলখানা হত্যা মামলায় যাঁরা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, তাঁরা কনডেম সেলে থাকেন। যাঁদের শাস্তি হয়েছে তাঁদের বেশির ভাগ আসামি অষ্টম শ্রেণি পাস। আমি যদি ইংরেজিতে রায় লিখি, তাঁদের বেশির ভাগই রায়টি বুঝবেন না। ব্যক্তিগতভাবে এসে রায়টি কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে বুঝে নেওয়াও সম্ভব নয়। কোন অপরাধে এবং কোন যুক্তিতে তাঁদের সাজা হয়েছে—সেটা তাঁরা যেন সহজে বুঝতে পারেন, সে চিন্তা থেকেই রায়টি বাংলায় লেখা।’
বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘উচ্চআদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই—এটা একটা সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। এখানে পরিভাষা নেই, বাংলায় লেখা যাবে না—এ কথা ঠিক নয়।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উচ্চআদালতে বাংলা প্রচলন না হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর একটি হলো—বেঞ্চ কর্মকর্তারা বিচারকদের ডিরেকশন বাংলায় সহজে লিখতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষায় আইনের প্রতিশব্দ কম। তৃতীয়ত, ইংরেজি ভাষায় রায় লেখা দীর্ঘদিনের প্রচলন। চতুর্থত, আইনের সব ভাষ্যই ইংরেজিতে। আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে—ইংরেজিতে লেখা আইনগুলো ভাষান্তর না হওয়া।’
এদিকে, ইংরেজিতে দেওয়া আদালতের রায়গুলো সহজেই বাংলায় অনুবাদ করার জন্য ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘আমার ভাষা’ নামের একটি সফটওয়্যারের উদ্বোধন করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান শনিবার এনটিভি অনলাইনকে এ বিষয়ে বলেন, ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের ইংরেজিতে দেওয়া রায় বাংলায় অনুবাদ করা যাবে। রায়গুলো বাংলায় অনুবাদ করে জনসাধারণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রচার করা হবে। সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য আইডি ও পাসওয়ার্ড তৈরি করে এরই মধ্যে অনুবাদকদের দেওয়া হয়েছে। তাঁরা পরীক্ষামূলকভাবে অনুবাদ করেছেন, যা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘উচ্চআদালতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার ব্যবহারে কোনো বাধা নেই। অন্য ভাষা থেকে বাংলায় ভাষান্তর করতেও কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উচ্চআদালতে এখন বাংলায় রায় দেওয়া বাড়ছে। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়মিত চর্চা ও অনুশীলনের বিষয়।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়াটা অত্যাবশ্যক। কারণ, দেশের নাগরিক—বিশেষ করে যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন—তাঁদের মামলার রায় ও আদেশ মাতৃভাষায় হওয়া বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া আমরা বহু আগেই ঔপনিবেশিক আমল পেরিয়ে এসেছি। তাই সে মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসাও অত্যন্ত জরুরি ও প্রাসঙ্গিক।’
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অন্তত বিচারপ্রার্থীদের কথা চিন্তা করে আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানো উচিত। এক সময় ছিল—আদালতের সবকিছু ইংরেজি ভাষায় পরিচালনা করা হতো। এখন সে পরিস্থিতি নেই। দিন দিন বাংলা ভাষার কদর আদালতে বাড়ছে। আমাদের অনেক বিচারপতি আছেন যাঁরা নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন। এটা অনেক আশার বাণী।’
উচ্চআদালতে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের পক্ষে মত দিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ শনিবার বিকেলে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ইংরেজিতে রায় লেখা বা আবেদন করা বাধ্যতামূলক নয়। ইচ্ছা করলে বাংলায়ও রায় লেখা যাবে। কোনো কোনো বিচারপতি বাংলায় রায় লিখছেন। তবে, সংখ্যায় খুবই কম। আমাদের আইনের বইগুলো ইংরেজিতে। এখন অবশ্য বাংলায় লেখা হচ্ছে। আমার বিশ্বাস আস্তে আস্তে এটার পরিবর্তন হবে। এতে সরকারকে মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এটা রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।’