করোনার ভয়কে জয় করে ছুটে চলছেন অবিরাম
নরসিংদীতে করোনা যুদ্ধে মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ আলম মিয়া। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও ১৫ দিনের শিশু সন্তানকে ঘরে রেখে ছুটছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের দ্বারে দ্বারে।
কখনো করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তিদের দাফন, কখনো বা সৎকার করতে দিবারাত্রি ব্যস্ত সময় পার করছেন। আবার কখনো হ্যান্ড মাইক হাতে মানুষের ভয়কে জয় করতে ছুটছেন পাড়া-মহল্লায়। কখনো খাবারের থলি নিয়ে ছুটছেন অসহায়, দুস্থ, নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্তদের বাড়ি বাড়ি। কখনো আবার লকডাউন নিশ্চিত করতে পথে প্রান্তরে ছুটছেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের কবল থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় বাজার মনিটরিং বা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন। গুজব রুখতে নজর দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নরসিংদী জেলার ২২ লাখ মানুষকে সুস্থ রাখতে ও ঘরে রাখতে দিন রাত চালাচ্ছেন সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন।
দুই মাস ধরে করোনাভাইরাসের সংকট মোকাবিলায় এইভাবেই চলছে নরসিংদী জেলা প্রশাসনের ৩৪তম বিসিএস ক্যাডার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ আলম মিয়ার নিত্যনৈমিত্যিক কর্মকাণ্ড। সব কিছুকে ছাপিয়ে সর্বশেষ করোনায় মৃত ব্যক্তি বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত প্রায় ১৫ জন মানুষের দাফন ও সৎকার করে প্রশাসনের এই কর্মকর্তা এখন জেলাজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মানবিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়ায় সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এখন ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
নরসিংদী সদর উপজেলার কুইক রেসপন্স টিমের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন শাহ আলম মিয়া। একসঙ্গে এত দায়িত্ব পালন, মানবিক গুণ ও কর্মদক্ষতায় তিনি এখন নরসিংদীতে সবার মধ্যে হয়ে উঠেছেন ‘বাস্তব জীবনের সুপার হিরো’ ও ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’।
জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ আলম মিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদর্শের প্রতি আমার দুর্বলতা রয়েছে। তাঁর ইচ্ছে জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলা। আর এ নির্দেশনাটি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করে চলেছেন নরসিংদীর জনবান্ধব জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমার মাতৃতুল্য অভিভাবক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন। যেকোনো পরিস্থিতিতে দৃঢ় মনোবল নিয়ে কাজ করার মতো করে তিনি আমাকে নিজে হাতে তৈরি করেছেন। আমাকে হাতে কলমে কাজ শিখিয়েছেন, মানবিক হতে সাহস যুগিয়েছেন, পরিশ্রমী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেই প্রেরণা থেকেই আমি দিনরাত কাজ করে চলেছি।’
২০১৬ সালে ৩৪তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নরসিংদীতে যোগ দেন শাহ আলম মিয়া। এরপর থেকে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়ে নরসিংদীর মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। জেলার সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের সঙ্গে সমানতালে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সততার সঙ্গে তিনি তাঁর দাপ্তরিক কাজ সম্পাদন করে চলেছেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে নরসিংদী সদরে তাঁর যোগদানের পর ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং দাপ্তরিক অন্যান্য কাজের স্বচ্ছতা ও গতিশীলতার জন্য তিনি ভূমি অফিসে আগত সেবাপ্রত্যাশী এবং তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন।
কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ শাহ আলম মিয়া ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ‘আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস ডে’ উপলক্ষে পরপর দুইবার নরসিংদীতে সেরা কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে সততা ও কর্মনিষ্ঠার জন্য তিনি জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার অর্জন করেন। এর আগে ২০১৪ সালে কারিতাস বাংলাদেশে কাজ করার সময় তিনি ‘ত্যাগ ও সেবা দিবসে’ শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। এছাড়া ২০১৫ সালে বাংলাদেশ কাস্টমসে কাজ করার সময় সেখানেও তিনি সেরা কর্মকর্তার সম্মান অর্জন করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষে ২০১৩ সালের শেষের দিকে কারিতাস বাংলাদেশে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন শাহ আলম মিয়া। এর আগে তিনি কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেন।
এ মাসের প্রথম সপ্তাহে শাহ আলম মিয়া ও তাঁর স্ত্রী আশার কোল জুড়ে আসে প্রথম সন্তান। এ সময় স্ত্রী ও সন্তানের পাশে তাঁর থাকার কথা থাকলেও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য থাকতে পারছেন না। কারণ তিনি করোনা রোগীদের সংস্পর্শেই বেশিরভাগ সময় কাটান। তাই তিনি নিজের থাকার রুম থেকে শুরু করে খাবার দাবারের জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড় সবই আলাদা করে নিয়েছেন। নরসিংদীর মানুষকে নিরাপদ রাখতে তিনি নিজের ভোগবিলাসকে উৎসর্গ করে পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখছেন।
জানতে চাইলে স্ত্রী আশা জানিয়েছেন, সংকট সারা জীবন থাকবে না। হয়তো চাকরির সময়ের পর তিনি আমাকে সময় দিতে পারতেন। তাতে শুধু আমি উপকৃত হতাম। এখন জেলার ২২ লাখ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। এই সংকটময় সময়ে তিনি নরসিংদীর লাখো মানুষের পাশে থেকে সেবা দিতে পারছেন, এর চেয়ে খুশির আর কিছুই নেই। তাঁর জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। তিনি যেন এইভাবেই প্রশাসনে থেকে প্রান্তিক মানুষকে সেবা দিতে পারেন।