করোনা থেকে মুক্তির প্রার্থনায় জলে ভাসল বৈসাবির ফুল
মহামারি করোনার ভয়াবহতায় বিপন্ন বিশ্ব। বিধিনিষেধের কারণে তাই এবারও পাহাড়ে ঘটাকরে উদযাপিত হচ্ছে না বৈসাবি উৎসব। তবুও প্রাণের টানেই অনাড়ম্বর ও সীমিত পরিসরে উদযাপন করা হচ্ছে।
আজ সোমবার উৎসবের প্রথম দিন মহামারি করোনা থেকে মুক্তি চেয়ে ফুলবিজুর ফুল কাপ্তাই হ্রদের জলে ভাসিয়েছে চাকমা ও ত্রিপুরা তরুণ-তরুণীরা।
মাহামারি করোনার কারণে সীমিত পরিসরে রাঙামাটিতে বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি উদ্যোগে কাপ্তাই হ্রদের জলে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বৈসাবির মূল আনুষ্ঠানিকতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম এই সামাজিক আয়োজনে ব্যস্ত এখন শহর, নগর আর পাহাড়ি পল্লিগুলো। এ সময় পানিতে ফুল ভাসিয়ে করোনা মহামারি থেকে মুক্তির জন্য গঙ্গাদেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয়।
২৯ চৈত্র চাকমা জনগোষ্ঠীর ‘ফুলবিজু’, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘হাঁড়িবসু’ আর মারমা সম্প্রদায়ের ‘সুচি কাজ’। ঠিক ফুলবিজু নামে অভিহিত না হলেও এই দিন প্রায় সব পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ পানিতে ফুল ভাসায়। এতে অগ্রগণ্য থাকে চাকমা ও ত্রিপুরারা।
এদিন, প্রথা অনুসারে ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের বিভিন্ন ঘাটে নিজ নিজ উদ্যোগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পানিতে ফুল ভাসানো হয়।
উৎসবপ্রিয় পাহাড়িরা সারা বছর মেতে থাকেন নানান অনুষ্ঠানে। তবে তার সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় বর্ষবিদায়ের এই উৎসব। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাই, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু-এভাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে আলাদাভাবে পালন করে এই উৎসব।
উৎসবের প্রথম দিনে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমারা বন থেকে ফুল আর নিমপাতা সংগ্রহ করে এবং পবিত্র এই ফুল ভাসিয়ে দেয় পানিতে, তাই একে বলা হয় ফুলবিজু। করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর কোনো আনুষ্ঠানিকতা না থাকলেও এ বছর সীমিত পরিসরে ব্যক্তি উদ্যোগে পানিতে ফুল ভাসিয়ে ফুল বিজু উৎসব পালন করা হচ্ছে।
পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরোনো বছরের দুঃখ-বেদনাকেই যেন ভাসিয়ে দিয়ে নতুন দিনের সম্ভাবনার আলো জ্বালায় পাহাড়ের মানুষ। পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরোনো দিনের বেদনা ভুলে নতুন দিনের প্রত্যয়ের কথা জানায় ফুল ভাসাতে আসা পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা।
রাজবাড়ীঘাটে ফুল ভাসাতে আসা অমৃতা চাকমা বলেন, ‘এটি পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ঐহিত্যবাহী সামাজিক উৎসব। করোনার কারণে গত বছর উৎসবটি সেভাবে হয়নি। এবার নির্দেশনা মেনে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বিশ্ব যেন করোনা থেকে মুক্তি পায় সেই প্রার্থনা করা হয় গঙ্গাদেবীর কাছে। আরও প্রার্থনা করা হয় আমরা যেন আগামী বছর সুন্দরভাবে আগের মতো করে উৎসবটি উদযাপন করতে পারি।’
অভিরূপা চাকমা বলেন, ‘সকালে ফুল সংগ্রহ করে ঘর সাজিয়ে এখন ফুল ভাসাতে এসেছি। ফুল ভাসনোর মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরের দুঃখ-বেদনাকে ভাসিয়ে দিলাম এবং নতুন বছর যেন আরও অনেক সুন্দর হয় সেই প্রার্থনা করলাম। করোনা থেকে দ্রুত বিশ্ব মুক্ত হোক। আমরা সবাই যেন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি সেই প্রার্থনাও করি।’
বৈসাবি উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ইন্টু মনি তালুকদার বলেন, ‘গত বছর করোনার কারণে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এবার ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হলেও হঠাৎ করোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সব আনুষ্ঠানিকতা স্থগিত করা হয়েছে। যে যার মতো বাড়ি এসে পাশে হ্রদের জলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফুল ভাসাচ্ছে। সবই হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে।’
পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা বর্ষকে বিদায় জানানোর এ অনুষ্ঠান তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচিত। এই উৎসব চাকমা জনগোষ্ঠী বিজু নামে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সাংগ্রাই, মারমা জনগোষ্ঠী বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বিষু, কোনো কোনো জনগোষ্ঠী বিহু নামে পালন করে থাকে। বৈসুকের ‘বৈ’, সাংগ্রাইয়ের ‘সা’ ও বিজু, বিষু ও বিহুর ‘বি’ নিয়ে উৎসবটিকে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ নামে পালন করা হয়। পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর থেকে পাহাড়ের সব জনগোষ্ঠীকে উৎসবে একীভূত করার জন্য এই সংক্ষেপে নামটিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।