চাঁদপুরের দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে করা মামলার রিভিশন আবেদন খারিজ
চাঁদপুর প্রতিদিনের সম্পাদক ও সমকালের চাঁদপুর প্রতিনিধি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী এবং বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি ইব্রাহীম রনির বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের করা মামলা খারিজের বিরুদ্ধে রিভিশন আবেদনও খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। মঙ্গলবার (১৬ মে) এ রায় দেন চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. সাহেদুল করিম।
আওয়ামী লীগ থেকে আজীবন বহিষ্কৃত ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের পক্ষে রিভিশনটি করেন তার সহযোগী আব্দুল কাদের মিয়া। এর আগে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করায় গত বছরের মার্চে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছিল। মামলার তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তা খারিজ করে দেন চাঁদপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক। গত ২ মে মামলা খারিজের বিরুদ্ধে রিভিশন আবেদনের শুনানি হয়। রিভিশন খারিজের মাধ্যমে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের ৫০কোটি টাকার মানহানির মামলা চূড়ান্তভাবে খারিজ হয়েছে।
আদালতে সাংবাদিকদের পক্ষে মামলার শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট বদিউজ্জামাল কিরন, অ্যাডভোকেট দেবাশীষ কর মধু, অ্যাডভোকেট আবদুল লতিফ, অ্যাডভোকেট আবুল কাসেম, অ্যাডভোকেট সেলিম আকবর, অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন, অ্যাডভোকেট খাদিজা আক্তার খুকি, অ্যাডভোকেট ইশরাত জাহান ইমা প্রমুখ।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের ২২ মার্চ চাঁদপুর প্রতিদিনের প্রকাশিত ‘চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত নৌযান জব্দ ও জড়িতদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। এ সংবাদের ভেতরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নাম উল্লেখ করে সেলিম খানের নামে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা তথ্যনির্ভর মানহানিকর সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এ জন্য সেলিম খানের ৫০ কোটি টাকার মানহানি করার অভিযোগ আনা হয় ওই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ওই সংবাদে ‘২০১৫ সাল থেকে পদ্মা-মেঘনা নদী থেকে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করে আসছেন ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের একটি চক্র।’ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘আদালত তাদের কয়েকটি নির্দিষ্ট মৌজায় ড্রেজিংয়ের অনুমতি দিয়েছেন কিন্তু সেই মৌজাগুলোর কোনও ম্যাপ তাদের কাছে নেই।’
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘২০২২ সালের ২২মার্চ চাঁদপুরের দুইজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছিলেন সেলিম খান। ওই মামলাটি আদালত ২০৩ ধারায় খারিজ করে দেন। এরপর মামলা খারিজের আদেশ বাতিলের জন্য বাদীপক্ষের রিভিশন আবেদন করেন। মামলার উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত রিভিশন আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন। এর ফলে মামলাটি যে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক তা প্রমাণিত হয়েছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিক ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী বলেন, ‘আমাদের হয়রানি করার জন্য মামলাটি করা হয়েছিল। তবে, আদালত যে রায় দিয়েছেন তা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। আমরা আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট।’
উল্লেখ্য, চাঁদপুরের নদী অঞ্চল থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোল করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ একটি চক্র। এমনকি অনুমতি ছাড়াই চেয়ারম্যান বছরের পর বছর বালু বিক্রি করেন। স্থানীয়দের ভাষ্য ও সরকারি দপ্তরের নথিপত্র অনুযায়ী, বালু উত্তোলনের কারণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। এ অবস্থায় চাঁদপুরের নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে ভাঙনকবলিত মানুষ, জেলে ও জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিআইডব্লিউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে সরকারি সম্পদ ও ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেন সাবেক জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। ওই চিঠির পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদপ্তর, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। বৈঠক শেষে জানতে চাইলে সাংবাদিকের কাছে সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে সম্পৃক্ত নৌযান জব্দ ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের তৎপরতায় উচ্চ আদালত বালু উত্তোলন বন্ধের রায় দেন। এরপরও সেলিম খান ও তার চক্রের অন্যরা বালু উত্তোলন করতে নানামুখী চেষ্টা চালিয়ে যায়। এরই অংশ হিসেবে তারা একাধিক রিট করেন। এরই মধ্যে সেলিম খানের বিরুদ্ধে ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান বাদী হয়ে গত বছরের ১ আগস্ট এই মামলা করেন। ওই মামলায় ১২ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সম্প্রতি তিনি জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বের হন।