চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি যৌক্তিক : টিআইবি
চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলমান শান্তিপূর্ণ ও আইনসম্মত আন্দোলন ঠেকাতে হুমকির বদলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধাসহ দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে আট ঘণ্টা, কখনওবা আরও অধিক সময় ধরে কাজের বিপরীতে এই সামান্য পারিশ্রমিক বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি।
চলমান সমস্যার সমাধানে বাগান মালিকদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিহার করতে হবে ও সরকারকে চা-শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে, ন্যায্য ও মানবিক উদ্যোগ নিতে হবে। একইসাথে, চা বাগান শ্রমিকদের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সমপর্যায়ের খাতের সর্বনিম্ন মজুরি বিবেচনায় নিয়ে জীবন ধারণের উপযুক্ত ও চা-শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য যৌক্তিক পারিশ্রমিক নির্ধারণে বাগান মালিক, চা সংসদ ও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে টিআইবি।
প্রতি দুই বছর পরপর চা-শ্রমিক ও বাগান কর্তৃপক্ষের মধ্যে মজুরি সংক্রান্ত চুক্তি নবায়নের রীতি রয়েছে, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মজুরি নির্ধারণে বাস্তবে একতরফাভাবে বাগান কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তথাপি গত ১৯ মাস ধরে চা-শ্রমিকরা মজুরি চুক্তির বাইরে রয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির এই সময় চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মাত্র ১৪ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব চা-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতি অবজ্ঞা ও নিছক উপহাসমূলক অধিকার লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছু নয় উল্লেখ করে আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জমান বলছেন, ‘সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী চা-শ্রমিকদের প্রাপ্ত আবাসনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়েও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, দেশের অন্য যে-কোনো খাতের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন ও বৈষম্যমূলক। অথচ সার্বিক বিবেচনায় এ খাতটি অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত দিয়েও কেউ বলতে পারেননি যে, চা-বাগানের মালিক পক্ষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা এমন কোনো অবস্থায় আছেন যে, যাদের অবদানের ওপর নির্ভর করে চা-শিল্প বিকাশমান, সেই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদানে তারা অক্ষম। বরং এটি একটি লাভজনক বাণিজ্যিক খাত। অন্যদিকে চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু মালিকপক্ষের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। চা-শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে চলমান আইনসম্মত আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবনের পাশাপাশি সমতাভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
গত বেশ কিছুদিন ধরে শ্রমিকরা নির্দিষ্ট সময় শান্তিপূর্ণ কর্মবিরতি পালনের মাধ্যমে বাগান কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা সত্ত্বেও শ্রম বিভাগের মহাপরিচালক সম্প্রতি একটি চিঠির মাধ্যমে চলমান আন্দোলনকে ‘শ্রম আইনের পরিপন্থি’ বলে হুঁশিয়ার করেছেন। যা মূলত চা-শিল্প মালিকদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতি একাত্মতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়, বলে মন্তব্য করেন ড. জামান।
তিনি বলেন, ‘দেশের ‘ন্যূনতম মজুরি বোর্ড’ অন্যান্য খাতের ন্যূনতম মজুরি যেখানে কয়েক গুণ বেশি নির্ধারণ করেছে, সেখানে কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের ‘গাইড লাইন’ উপেক্ষা করে বারবার চা-বাগান মালিক পক্ষের নির্ধারণ করা ন্যূনতম মজুরির হার বহাল রেখে শ্রম মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
টিআইবি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে “চা বাগানের কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়” শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে চা-শ্রমিকদের জীবন-মানের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে ন্যায্য ও অন্যখাতের সাথে সমতাভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধাারণসহ বেশ কিছু সুপারিশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট তুলে ধরে। যেমন- শ্রমিকদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা; বাগানগুলোতে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিতকরণে “কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের” পক্ষ থেকে কার্যকর পরিদর্শন বাড়ানো; সমঝোতা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মাস আগে, শ্রমিক ও বাগান কর্তৃপক্ষের আলোচনা শেষ করতে হবে এবং চুক্তি নবায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে, যাতে মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথে তা কার্যকর করা যায়। সংস্থাটি মনে করছে, চলমান আন্দোলনের মানবিক সমাধানে উল্লিখিত সুপারিশসহ টিআইবি কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনটি এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবমুখি।