ডাকাতি মামলায় জামিন পেয়ে গরু চুরি করতে গিয়ে ফের ধরা
ওরা পাঁচজন। দাড়ি-গোঁফে ঢাকা পরিপাটি চেহারা। শ্মশ্রুমণ্ডিত চেহারায় প্রথম দর্শনেই শ্রদ্ধায় ভক্তিমূলক সম্বোধন চলে আসে অনায়াসে। তবে অবাক করা বিষয় হলো, মুরুব্বি হিসেবে সালাম কিংবা আদাব বিনিময়ের মতো চেহারার আড়ালেই চলতো অপরাধের সাম্রাজ্য। তাদের সবার পেশা গরু চুরি। ডাকাতি থেকে গাড়ি চুরিতেও সিদ্ধ হস্ত কেউ কেউ। পুলিশের ক্রিমিনাল ডাটাবেজ ঘেঁটে গরু চুরি আর ডাকাতিতে খোদ দলনেতার নামেই মিলেছে ১৬টি মামলা। এই খতিয়ান দেখে চক্রটির অপরাধ সম্পর্কে সন্দেহের সীমাও ছাড়িয়ে গেছে গোয়েন্দাদেরও।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার চোরচক্রের অন্যতম সদস্য মাসুদ মিয়া মামলার খতিয়ান সম্পর্কে সাফ জানান, সেগুলো কোনো বিষয় নয়। মামলাগুলো তাদের কাছে নিছক সংখ্যা মাত্র। এ ছাড়া অন্য সবার নামেই রয়েছে ডজনখানেকের মতো মামলা। রয়েছে জেলায় জেলায় সুনিয়ন্ত্রিত নেটওয়ার্ক আর গরু চুরি থেকে পরিবহণ ও বিক্রিতে রয়েছে নিজস্ব খামার ও ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস। সেই সাথে চুরির কাজে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জাম।
তবে বিধিবাম। এবার তারা ধরা পড়েছে নরসিংদী জেলা পুলিশের হাতে। গতকাল রোববার (২৬ মার্চ) গভীর রাতে নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ইটাখোলা মুন্সেফচরে গ্রামের কাঁঠালতলা মোড় থেকে একটি পিকআপভ্যান আর চুরির কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামসহ চক্রের সদস্যরা ধরা পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা গ্রামের মৃত আব্দুল কাদিরের ছেলে হোসেন আলী (৫৫), মাসুদ মিয়া (৩০), নরসিংদীর বেলাবো থানার পোড়াদিয়া গ্রামের মৃত আজম আলীর ছেলে বিল্লাল হোসেন (৪৮), শিবপুর থানার খরমপাড়া গ্রামের দানেশ ভূইয়ার ছেলে অহিদউল্লাহ ভূইয়া (২৫) ও এছহাক মিয়া (৫১)। গোয়েন্দারা বলেছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা যেসব তথ্য পাচ্ছি তা রীতিমতো বিস্ময়কর। কারণ গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মাসুদ মিয়া ও হোসেন আলী গত বছরের ৮ জানুয়ারি নরসিংদী জেলার পলাশ থেকে ডাকাতির সময় পিকআপভ্যান ও দেশীয় অস্ত্রসহ ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। বছর ঘুরতেই এত মামলা মাথায় নিয়ে জব্দ করা সেই পিকআপ ভ্যানসহ কীভাবে তারা একের পর এক চুরি করে যাচ্ছে? সেই প্রশ্ন তদন্তকারী কর্মকর্তাদেরও।
‘আমাদের যে বেশ দেখছেন মূলত এটা নির্বিঘ্নে গরু চুরির জন্য। আর আপনারা যে মামলার সংখ্যা বলছেন- সত্যি বলতে তা আমাদের কাছে নিছক সংখ্যার মতোই। কারণ আমাদের ধরতে আপনাদের কষ্ট হলেও ছাড়া পেতে ততো বেগ পেতে হয় না। আমাদের নেটওয়ার্কের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করা আছে। একজন ধরা পড়লে অন্যদের কি ভূমিকা হবে তার স্ট্যান্ডিং অর্ডার সকলকেই দেওয়া আছে’ ধরা পড়ার পর এমনটাই বলছিলেন গরু চোর দলের সরদার হোসেন আলী (৫৫)।
পুলিশ বলছে, গত ২৩ মার্চ গভীর রাতে নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার কুমারদী গ্রামের সাকিল ভুইয়া নামের এক ব্যক্তির গোয়াল থেকে চারটি গরু চুরি হয়। বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয় জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে।
নরসিংদী জেলার গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার জানান, প্রযুক্তির সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ে সোর্স নিয়োগ করে গরু চুরির প্রস্তুতির সময় তাদের আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়েই বেড়িয়ে আসে নানান তথ্য।
এ বিষয়ে নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম জানান, পাঁচজনের এই চক্রের নেটওয়ার্ক এতটা শক্তিশালী যে, তাদের পিছু নিতে আমাদের রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হয়েছে। মামলা দায়েরের পর আমার গোয়েন্দা টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয় জড়িতদের গ্রেপ্তারে। তারা দ্রুত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছেন। এটাই স্বস্তির ঘটনা। কারণ যে গৃহস্থের গরু চুরি হয় একমাত্র সেই বোঝে তার কষ্ট কতখানি।
গ্রেপ্তারের পর আজ সোমবার (২৭ মার্চ) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটকরা। পুলিশ সুপার আরও জানান, ‘আমরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু মজার তথ্য পেয়েছি এই চক্রের কাছ থেকে। প্রথমে তারা রেকি করে মূলত গোয়াল আছে এমন বাড়ির গোবরের স্তুপ লক্ষ্য করে। তারা আমাদের জানিয়েছে, গোয়ালের বাইরে গোবরের পরিমাণ দেখে তারা অভিযান স্থির করে। যে স্তুপে যত বেশি গোবর, সেখানেই অধিক গরু থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে তারা অভিযান চালায়।’
‘চোরাই গরু নিরাপদে রাখার জন্য হোসেন পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার কাইনালীভিটা এলাকায় তৈরি করেছে গরুর খামার। মূলত সেই খামার থেকেই নির্বিঘ্নে পরিবহণ করা হতো চোরাই পশু। আমরা অনুসন্ধান করে জেনেছি, ব্যবসায়ী পরিচয়ে হোসেন আলী নিজের ছেলে ও মেয়েকে বিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এলাকায় তাকে সবাই বেশ সমীহ করেন।’
নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম আরও বলেন, ‘এলাকাবাসী সন্দেহের আড়ালে থাকতে পরিবার নিয়ে হোসেন আলী থাকতেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানার মদন এলাকায়। তার বিরুদ্ধে জামালপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ গাজীপুর ও নরসিংদীর বিভিন্ন থানায় ১৬টি মামলা রয়েছে। এই চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কিছুটা হলেও গেরস্তের মনে স্বস্তি আসবে, এটাই আমাদের প্রাপ্তি।’