তদন্ত কমিটি গঠনের পর মুকিতকে নিয়ে মুখ খুলছেন স্থানীয়রা
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান মুকিতের পরিবারের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে মুকিত ও তার পরিবারের বিষয়ে কথা বলছেন মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশে গত মাসের শেষের দিকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা আওয়ামী লীগ।
কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সুলতান আলী মণ্ডলকে। সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক পিয়ারুল ইসলাম, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জরিদুল হক ও দপ্তর সম্পাদক সাইফুল আলম সাকাকে।
গত মাসের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ সামস-উল আলম হীরু ও সাধারণ সম্পাদক আবু বকর। তবে ঈদের কারণে তদন্ত বিলম্ব হবে বলে আগেই জানিয়েছিলেন তদন্ত কমিটির প্রধান সুলতান আলী মণ্ডল। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে পলাশবাড়ী এলাকায় গিয়েছিলাম। পুরোনো আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঈদের কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। আশা করি তদন্ত রিপোর্টে প্রকৃত ঘটনা আমরা তুলে ধরতে পারব।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনুমোদনে গত ১৩ মার্চ পলাশবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের পাঁচ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়।
ওই কমিটিতে সভাপতি পদে শামিকুল ইসলাম লিপন, সহ সভাপতি সাইফুল্লাহ রহমান চৌধুরী তোতা, সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মণ্ডল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বাবু, সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান মুকিতের নাম ঘোষণা করা হয়।
কমিটি ঘোষণার পর পলাশবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক মো. আমিনুল ইসলাম কেন্দ্রে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেন যে, মুকিতের পরিবারের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে মুকিত এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের শিকার।
তদন্ত কমিটির রিপোর্টের অপেক্ষায় আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। তারা বলছেন, প্রয়োজনে আমরা আন্দোলনে যাবে। যেহেতু তদন্ত চলছে, আমরা তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষায় আছি।
পলাশবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, বিদায়ী কার্যনির্বাহী সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য উপকমিটির সদস্য তামান্না শারমিন বলেন, ১৯৯০ সালে মুকিতের বাবা প্রফেসরপাড়ায় আমাদের তিনটি বাসার একটি ভাড়া নিয়েছিল। আশপাশের লোকজন তার বাবা জামায়াত করে এমন অভিযোগ দিলে, আমার বাবা তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আধঘণ্টার মধ্যে বের করে দেন। এটা পলাশবাড়ীর সবাই জানেন। এছাড়া তাঁর মা কলেজের প্রিন্সিপাল, উনি শিবির ও ছাত্রী সংস্থার ছেলে-মেয়েদের সবসময় বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। তাদের নিয়ে মিটিং করতেন। এটাও সবাই জানে। আমি নিজেও বিষয়টা ভালোভাবে জানি। এরকম জামায়াত পরিবারের ছেলে কীভাবে সাংগঠনিক সম্পাদক হয়? আমি তদন্ত কমিটির কাছে আমার স্টেটমেন্ট দিয়েছি। আমার জানা মতে, শতকরা ৯৫ ভাগ লোকই তার পরিবারের জামায়াত সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে। এত কিছুর প্রমাণ থাকার পরেও আর কী তদন্ত করা দরকার?”
২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পলাশবাড়ী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা আসাদুজ্জামান শেখ ফরিদ বলেন, “মুকিতদের বাসা শিবিরের মেস, এটা এলাকার কোন লোক না জানে। সর্বশেষ ২০১৩ সালেও পুলিশ অভিযান চালিয়ে বহু জামায়াত-শিবিরের বই পুস্তক পেয়েছেন। আমাদের ছেলেরা এই মেস কয়েকবার ভাঙচুর করেছে। তদন্ত কমিটি আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি আমার কথা বলেছি। এখন দেখি উনারা কী করেন।
পলাশবাড়ী উপজেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আতিক হাসান মিল্লাত বলেন, আমরা ২০ বছর আগের খবর জানি না। তবে এলাকার মুরব্বি, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের কাছে এই পরিবারের কারণে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতারা কী পরিমাণ নির্যাতনের শিকার হয়েছে, সেটা শুনেছি। ২০১৩ সালেও তাদের বাসায় শিবিরের মেস ছিল। যেটা তার মা পরিচালনা করতেন। আর সেই পরিবার থেকে কীভাবে আওয়ামী লীগের নেতা হয়?
আমরা এখন অপেক্ষায় আছি, তদন্ত কমিটি কি রিপোর্ট দেয়, সেটা দেখে, সিনিয়র নেতা, সাবেকদের সিদ্ধান্ত অনুসারে, পরবর্তীতে কি করবো সেটা সিদ্ধান্ত নেব।
পলাশবাড়ীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমান সরকার বলেন, গতকাল তদন্ত কমিটি আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি তাদের পারিবারিক অবস্থা বলেছি। এখন দেখি তদন্ত কমিটি কি রিপোর্ট দেয়।
পদ রক্ষা করতে বাবাকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বানাতেও চেষ্টা করেছে মুকিত
কিছুদিন আগে মুকিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাঁর ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সব মিথ্যা। কারণ তাঁর বাবা কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছিলেন না। জামায়াতের সঙ্গে তো ছিলেনই না। বরং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকার কাঁঠালবাড়ি ব্রিজ ভাঙা অপারেশনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তাঁর বাবা পলাশবাড়ী সরকারি কলেজের প্রভাষক থাকাকালীন ২০১০ সালে মারা যান। আর তাঁর মা পলাশবাড়ী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অবস্থায় অবসরে গিয়েছেন। বর্তমানে তিনি গাইবান্ধা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি।
এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন গাইবান্ধা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য পলাশবাড়ীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমান সরকার। তিনি বলেন, এই দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। মুকিতের বাবার নাম হাবিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এখান থেকে হাবিব নামে যিনি যুদ্ধ করেছেন, তিনি মুকিতের বাবা নন। আসল মুক্তিযোদ্ধা যিনি (হাবিব), তার কাছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেটও রয়েছে। তার বাবা যখন কলেজের প্রিন্সিপাল তখন থেকে আমার সঙ্গে পরিচয়। হাবিবুর রহমান সাহেব তো কোনদিন আমাকে বলেননি যে, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন বা করতে চান। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন সেটাও বলেননি। এগুলো পদ রক্ষার জন্য অনেকে বলে, তাই মনে হয় বলেছে।
মুকিতের মা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমান বলেন, তাঁর (মুকিতের মা) বাবা মুসলিম লীগের হয়ে নির্বাচন করেছে হারিকেন প্রতীক নিয়ে। তার পরিবারের সবার জামায়াত সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।