পটুয়াখালীতে ১৩ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, পানিতে ডুবে নিহত ২
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পটুয়াখালী জেলার নদনদীর পানি ফুঁসে উঠেছে। জলোচ্ছ্বাসে এ পর্যন্ত ৬০০ নলকূপ, ৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ৫৫ কোটি টাকার মৎস্য খাত ক্ষতিগ্রস্তসহ ১৩ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। কলাপাড়া ও দুমকি উপজেলায় অতিরিক্ত জোয়ারের তোড়ে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে এক নারী ও এক শিশুর।
আজ বৃহস্পতিবারও জেলা শহরসহ উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল তিন-চার ফুট জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সকাল থেকে অব্যাহত দমকা হাওয়ার সঙ্গে জোয়ারের পানি বৃদ্ধিতে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলের মানুষের মনে আশঙ্কাসহ দুর্ভোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আজও নদনদীতে বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে।
জেলা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে আজও দমকা হাওয়া অব্যাহত রয়েছে। দমকা হাওয়ার সঙ্গে জোয়ারের পানি স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে তিন থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানান জেলা আবহাওয়া দপ্তরের পর্যবেক্ষক মো. রাহাত হোসেন।
পটুয়াখালী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফায়েজ আহম্মেদ জানান, জোয়ারের পানি অত্যাধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রাথমিকভাবে তারা ছয় শতাধিক টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ার তথ্য পেয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রতিটি এলাকায় পর্যাপ্ত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি টিউবওয়েল নষ্ট হয়েছে কলাপাড়ার বেড়িবাঁধহীন লালুয়া ইউনিয়নে।
পটুয়াখালী জেলার আট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট ১৩ হাজার ১৩৭টি কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে ২৩২টি গ্রাম।
পটুয়াখালী সদর উপজেলায় দুই হাজার ৩০০ পরিবার, ৩৬২টি ঘরবাড়ি, তিনটি স্টিল ব্রিজ, ৩৯.১৯ মিটার পাকা রাস্তা, ৭৫০ মিটার কাঁচা রাস্তা, ৩১ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
মির্জাগঞ্জ উপজেলায় ১০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। রাঙ্গাবালী উপজেলায় ১৯টি স্পটের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ৩৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
গলাচিপা উপজেলায় ২০০ ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ১৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কলাপাড়া উপজেলায় দুই হাজার ২৩০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বেড়িবাঁধ ভেঙে ৭৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দশমিনা উপজেলায় ২২০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ব্যাপক এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দুমকী উপজেলায় নয়টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে, সর্বত্র জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় ফসলের ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা যায়নি বলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানিয়েছেন, পটুয়াখালীতে ইয়াসের প্রভাবে উচ্চ জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে সাত হাজার পুকুর ও ঘের। যার মধ্যে পাঁচ হাজার ৭০০ পুকুর এবং এক হাজার ৩০০ ঘের। ক্ষতির পরিমাণ ৫৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাঙ্গাবালী উপজেলার ৮০ ভাগ মাছের ঘের তলিয়ে গেছে।
আজ দুপুরে পুনরায় জোয়ারের পানিতে তলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলার চরকাশেমের মো. লুৎফর রহমান বাবুল জানান, তার দুটি ঘেরের কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। আজও জোয়ারের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম সালেহীন জানান, গত দুই দিনে পটুয়াখালীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ লালুয়ার সাত কিলোমিটারসহ ৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীর তীর ভেঙে গেছে তিন কিলোমিটার এলাকায়। আজও স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে জোয়ারের পানিতে খেলতে গিয়ে ডুবে সায়মা (৭) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের নাচনাপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। জোয়ারের পানি বৃদ্ধির ফলে বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় পানিতে খেলতে গিয়ে সায়মা আজ দুপুরে নিখোঁজ হয়। পরিবারের লোকজন তাকে দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজির পর বাড়ির পিছনে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে থাকা একটি ডোবা থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মৃত সায়মা নাচনাপাড়া গ্রামের মো. ফরিদ উদ্দিনের মেয়ে।
অপরদিকে, জোয়ারের পানির অতিরিক্ত চাপে নদীতে নেমে পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার মুরাদিয়ার সন্তোষদি গ্রামের হাসিনা বেগম (৫৫) প্রাণ হারিয়েছেন।
জানা গেছে, পাশের ঝিলনা নদীর সন্তোষদি চর এলাকায় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হোগলাপাতা কাটতে গেলে জোয়ারের পানির প্রবল চাপে ভেসে যান হাসিনা বেগম। পরে ওই চরের নিকটবর্তী এলাকায় দুপুর ১টার দিকে হাসিনা বেগমকে ভাসমান অবস্থায় নদীতে মাছ ধরা জেলেরা দেখতে পেয়ে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মুরাদিয়ার ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হাসিনা বেগম মৃত হাফেজ হাওলাদারের স্ত্রী। তিনি পাঁচ কন্যা সন্তানের জননী।
দুমকী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ আব্দুল্লাহ সাদিক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
এ দিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে আজও পটুয়াখালীতে নদনদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাকিম সালেহীন।