পদ্মা সেতু উদ্বোধন ঘিরে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ জুন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের এক দিন পর ২৬ জুন সকাল থেকে বহুলপ্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।
দেশের এ বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপ দিতে প্রকৌশলী ও কর্মীরা ২১ ঘণ্টা করে কাজ করছেন। এ সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার ভ্রমণ সময়কে কমিয়ে আনবে অনেকটা।
ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ
পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) শফিকুল ইসলাম জানান, চূড়ান্ত রূপ দিতে ছোটখাটো কিছু বিষয়ে কাজ করছেন তাঁরা। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে সব ধরনের কাজ সম্পন্ন করা হবে।
পিডি শফিকুল ইসলাম বলেন, এ সেতুতে ৪০০ লাইট থাকবে, যেগুলো ফাইন টিউনিং প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘আমাদের অনেক ল্যাম্পপোস্টের দিক ঠিক করতে হবে এবং আবার পরীক্ষা করা হবে। এ ছাড়া সেতুর দুই প্রান্তের সংযোগ সড়কে আরও ২০০টি স্ট্রিট লাইট স্থাপন ও বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ চলছে।’
উদ্বোধন ও আমন্ত্রণ
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) রূপম আনোয়ার বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণপত্র পাঠানোর কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তিনি আরও জানান, যাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হবে, তাঁদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। আগামী সপ্তাহ থেকে আমন্ত্রণ জানানো শুরু হবে।
রূপম আনোয়ার বলেন, ‘সরকারি, বিরোধী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, টিভি অনলাইন রেডিও সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এদিন আমন্ত্রণ জানানো হবে।
আগামী ২৫ জুন সকাল ১০টায় পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পিডি শফিকুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি প্রথম টোল পরিশোধ করে চার লেনের সেতু পার হবে। জাজিরা প্রান্তে উদ্বোধনের পর একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে প্রায় ১০ লাখ লোক সমাগম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।‘ তিনি বলেন, উদ্বোধনের আগে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে আমন্ত্রণ, বিনোদন, যানবাহন ও পরিবহনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৮টি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকালে নির্দিষ্ট যানবাহন ছাড়া কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনুমতি দিলেই সেতুতে লোকজন উঠতে পারবে।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনের দিন দুপুর থেকে পদ্মা সেতু খোলা থাকবে। এ সময়ে কী করা হবে, তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে কবে থেকে যানবাহন চলাচল করতে পারবে এবং কত দিন সাধারণ মানুষকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে সে বিষয়ে সরকার গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবে।
ভাড়া ও টোল
সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেতু বিভাগ কর্তৃক জারি করা একটি গেজেট প্রজ্ঞাপন অনুসারে, সরকার ১৭ মে পদ্মা সেতু পারাপারের জন্য বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের জন্য টোলের হার চূড়ান্ত করেছে।
সরকার নির্ধারিত টোল হার অনুযায়ী, পদ্মা সেতু পারাপারে মোটরসাইকেলে ১০০ টাকা, কার ও জিপে ৭৫০ টাকা, পিকআপে এক হাজার ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসে এক হাজার ৩০০ টাকা টোল পরিশোধ করতে হবে। বাসের ক্ষেত্রে ছোট বাস (৩১ আসন) এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাস (৩২ আসন বা এর বেশি) দুই হাজার টাকা, বড় বাস (থ্রি-এক্সেল) প্রতি দুই হাজার ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে।
এছাড়া ছোট ট্রাককে (পাঁচ টন পর্যন্ত) এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে (পাঁচ টনের বেশি ও সর্বোচ্চ আট টন পর্যন্ত) দুই হাজার ১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (আট টনের বেশি ও সর্বোচ্চ ১১ টন) দুই হাজার ৮০০ টাকা, ট্রাকে (থ্রি-এক্সেল পর্যন্ত) পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা, ট্রেইলার (ফোর-এক্সেল পর্যন্ত) ছয় হাজার টাকা। আর ট্রেইলার (ফোর-এক্সেলের অধিক) ছয় হাজারের সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য এক হাজার ৫০০ টাকা যুক্ত হবে।
গত ৭ জুন সরকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার জন্য পদ্মা সেতু পারাপারের জন্য নির্ধারিত টোল যোগ করে ১৩টি রুটে বাস ভাড়া বাড়িয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা-ভাঙ্গা-মাদারীপুর-বরিশাল রুটে বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪১২ টাকা। এছাড়া ঢাকা-রাজৈর-গোপালগঞ্জ রুটে ৫০৪ টাকা এবং ঢাকা-গোপালগঞ্জ-খুলনা রুটে ভাড়া ৬৪৯ টাকা। ঢাকা-জাজিরা-শরীয়তপুর রুটে ২১৮ টাকা, ঢাকা-বরিশাল-পিরোজপুর ৫৩৪ টাকা, ঢাকা-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট-পিরোজপুর ৬২৮ টাকা, ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী ৫০১ টাকা এবং ঢাকা-ভাঙ্গা-মাদারীপুর ৩৭২ টাকা।
এছাড়া ঢাকা-গোপালগঞ্জ-খুলনা-সাতক্ষীরার ভাড়া ৬৩৩ টাকা, ঢাকা-ভাঙ্গা-ফরিদপুরে ২৮৮ টাকা, ঢাকা-মাদারীপুর-বরিশাল-ভোলা-চর ফ্যাশনে ৬৫৩ টাকা, ঢাকা-বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু-শরীয়তপুরে ২১৯ টাকা। এবং ঢাকা-মাদারীপুর-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা ৬৯৪ টাকা। সেতু উদ্বোধনের পর থেকে এ নতুন হার কার্যকর হবে।
দেশের উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিমের সঙ্গে সংযোগকারী পদ্মা সেতুর শুরুর কথা
রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা সেতু। সেতুটি মাওয়া, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জকে দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরীয়তপুর, শিবচর ও মাদারীপুরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সেতুটির প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ২০০১ সালে একটি জাপানি কোম্পানির সহায়তায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছিল।
২০০৪ সালের জুলাই মাসে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সুপারিশে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাওয়া ও জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেতুর নকশা চূড়ান্ত করে।
একনেক সভায় অনুমোদন
২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ের পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে নকশার পরিবর্তন ও দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ ব্যয়ও বেড়েছে।
২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারও আট হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সবশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়ন।
আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল রেল সংযোগ সহ দ্বিতল সেতুটির নকশা করেছে। পদ্মা সেতুর উভয় প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ।
প্রকল্পের সময়কাল ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অনুমান করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় চার হাজার লোক কাজ করছে।
চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের অধীনে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি মূল সেতু নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল এবং লিংক রোডের জন্য চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড চায়না লিমিটেড চুক্তিবদ্ধ হয় যার চুক্তি মূল্য ছিল যথাক্রমে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা কোটি টাকা এবং আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা কোটি টাকা।
২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার তারিখ ছিল ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর। পরে সময় বাড়ানো হয়। সেতুটির জন্য ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ দুই হাজার ৬৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর।
রেল সংযোগ
গত বছরের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণ প্রকল্প’-এর আওতায় ঢাকা ও যশোরের মধ্যে রেল সংযোগের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণ প্রকল্প’-এর প্রথম ধাপে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে মাওয়া ও ভাঙ্গা হয়ে জাঞ্জিরা ও শিবচরের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন করা হবে।
এটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোরকে সংযুক্ত করবে।
চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড, একটি চীনা সরকার মনোনীত ঠিকাদার, চীন জি২জি সিস্টেমের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
১৫ মে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, আগামী বছরের মার্চ মাসে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
তিনি বলেন, প্রযুক্তিগত কারণে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা রেল সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা থাকলেও পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় সেতুর ওপরের অংশে কাজ করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার রেলপথের অগ্রগতি প্রায় ৬০ দশমিক ৪ শতাংশ, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেলপথের অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেল সেতুর সার্বিক অগ্রগতি ৫৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত মোট ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ প্রকল্প ২০২৪ সালে শেষ হবে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকার দিবে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং বাকি অর্থ দেবে চীন সরকার।