প্রতিবন্ধী নাতি নিয়ে রাস্তার ধারে দেড় যুগ ধরে বিধবা সখিনা
বিধবা সখিনার বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। তিনি স্বামীকে হারিয়েছেন প্রায় ৪০ বছর আগে। তিন ছেলে ও এক মেয়ের সবাই না ফেরার দেশে। পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই তাঁর। তাই, কেউ খোঁজ রাখে না তাঁর।
জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে খুব ভালো নেই সখিনা। শরীরে বল নেই, ঠিকমতো চলাফেরাও করতে পারেন না। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতা ভর করেছে তার শরীরে। চিকিৎসা খরচ তো দূরের কথা, নেই থাকা-খাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত। অনাহারে-অর্ধাহারে প্রতিবন্ধী নাতিকে নিয়ে দিনাতিপাত করছেন তিনি। ভিক্ষা করে জীবন চলে তাঁর।
নেই মাথা গোঁজার ঠাই, রাস্তার পাশে ঝুপডি একটি ঘর তুলে রাত যাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে এলাকাবাসী। দির্ঘদিন ধরে এই ঘরেই বসবাস করছেন সখিনা। ভাঙ্গা পুরাতন টিন দিয়ে তৈরি তার ঘরটি। হাজারো ফুটো দিয়ে বর্ষায় পানি ঘরে ঢুকে। শীতে কী অবস্থা হয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এভাবেই কষ্টে কাটছে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বালারহাট ইউনিয়নের কয়েরমারী গ্রামের বিধবা সখিনার জীবন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বালারহাট ইউনিয়ন পরিষদ হতে এক কিলোমিটার দক্ষিণে খালেক মোড়। সেখান থেকে পূর্বদিকের কয়েরমারী গ্রাম। গ্রামের প্রবেশ পথেই রাস্তার ধারে সখিনা বেওয়ার পুরোনো সেই টিনের ঝুপড়ি ঘর। সেখানে প্রতিবন্ধী নাতি চেংটু মিয়াসহ বসবাস তাঁর। পাশাপাশি লাগানো দুটি ঘর। একটিতে সখিনা বেওয়া অন্যটিতে চেংটুর বাস। সেখানে নেই থাকার পরিবেশ। টিনগুলোতে অসংখ্য ছিদ্র। ঘরের ভেতর রয়েছে একটি চৌকি। তার উপর কাঁথা বিছিয়ে রাত যাপন করেন তাঁরা। নেই খাওয়ার ব্যবস্থা। বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে যেটুকু পায়, সেটুকু দিয়ে চলে দাদি-নাতির দিন। বেশিরভাগ সময় না খেয়ে দিন পার করেন তারা। জনপ্রতিনিধ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি।
কয়েরমারী গ্রামের ছয়ফুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের কেউ নেই। থাকার জায়গা ছিল না। প্রায় দেড় যুগ আগে আমি রাস্তার ধারে ঘর তুলে দিয়েছি। সেখানে থাকেন তারা। আমরা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অনেক বলেছি, তাদের একটি ঘর দেওয়ার জন্য। একের পর এক চেয়ারম্যান বদল হয়েছে কিন্তু ঘর পায়নি তারা।’
আরেক গ্রামবাসী দুলা মিয়া বলেন, ‘দুজন মানুষ দির্ঘদিন ধরে কষ্ট করে রাস্তায় বসবাস করছেন। কেউ দেখার নেই। আমরা একাধিকবার চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে গেছি, কাজ হয়নি। তাকে একটি ঘর দিলে শেষ বয়সে একটু শান্তিতে মরতে পারবে।’
গ্রামের তরুণ সংগঠক স্বাধীন আহমেদ বলেন, ‘তারা মানুষের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে খায়। আমরা গ্রামের ছেলেরা মিলে তাদের মাঝেমধ্যে সাহায্য করি। তারপরও অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়। মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী গৃহহীন পরিবারকে ঘর দিয়েছেন। আমি এই অসহায় দুজন মানুষের পক্ষে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, তাদের যেন একটি ঘর দেওয়া হয়।’
সখিনা বেওয়া বলেন, ‘বাবা মুই গরির মানুষ। মানুষের বাড়িত চায়া-মাঙ্গি খাও। যখন কেও দেয় না, তখন না খায়া থাকো। মোর বাড়ি নাই। রাস্তাত মানুষ ঘর তুলি দিছে, ওটি থাকো। মুই আর কতদিন বাঁচিম, মরব্যার আগে নয়া ঘরোত থাকপ্যার চাও।’
সখিনা বেওয়ার নাতি প্রতিবন্ধী চেংটু মিয়া বলেন,‘ মুই মানষের বাড়িত মাঝেমধ্যে কাম করো। তারা কিছু খাবার দেয়, সেগল্যায় খাও। বেশিভাগ সময় না খায়া থাকো।’
এ বিষয়ে বালারহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত রতন বলেন, ‘আমি খোঁজ-খবর নিয়ে বিষয়টি দেখব। যদি প্রাপ্য হয়ে থাকে, তাহলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’