বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা থেকে আমরা যোজন-যোজন দূরে
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একক কোনো ব্যক্তি নন, হয়ে উঠেছিলেন প্রতিষ্ঠান। তাঁর চিন্তা-চেতনা মানুষ শুধু ধারণই নয়, পালন করারও চেষ্টা করত। আর তাই তাঁর ডাকে আপামর জনসাধারণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। রক্তের বন্যা বইয়ে হলেও জন্ম দিয়েছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশের। আর তার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর ঘাতকেরা তাঁকে বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে কেড়ে নেয় বাংলার বুক থেকে। কিন্তু কেড়ে নিয়ে যেতে পারেনি তাঁর আদর্শ ও চিন্তা-চেতনাকে। তবে তাঁর সেই আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা মানুষ এখন কতটুকু পালন করে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে নানা মহল থেকে।
আবার কেউ বা বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এখন অনেকটাই মুখে মুখে। মানে, কাজে-কর্মে নয়; শুধু বয়ানে। কেউ বলেন, অনেকেই তাঁকে সম্মান করে তাঁর চিন্তা লালন করার চেষ্টা করে। কেউ কেউ বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলেও চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে, সে কথাও বলেন কেউ কেউ।
কয়েকদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চিন্তা আর বর্তমান অবস্থা নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের। কথা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্নের সোনার বাংলা, সেটা কোনোমতেই পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয় নাই। তবে বাস্তবায়নের পথে অনেকদূর অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু পূর্ণতা আসে নাই। আমরা আশা করছি, এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার যদি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে—তাহলে এ দেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত করা সহজতর হবে।’
রাজধানীর কাঁঠালবাগানের স্থায়ী বাসিন্দা হোসেন আলী। বয়স ৭০ বছর। তাঁর কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেই সময়কার বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা, জীবনবোধ কিংবা চেতনা যা আপনারা দেখেছিলেন; এখন তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে দেখেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার চাচা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে গিয়ে তিনি শহীদ হন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ যুদ্ধ করেছে ন্যায়-নীতির পক্ষে, জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং জনগণের রায়ের পক্ষে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেত না এই দেশে। তারপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চস্বরে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে থাকে। কিন্তু তাঁর চেতনা ধারণ করে কাজ করার মানুষ কমই দেখা যায়। এখন তো দেখি, সেই আগের মতোই অবস্থা। যেসব কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেসব কারণ এখনো সমাজে বিদ্যমান। তখন মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলত, এখন তো তাও কাউকে বলতে দেখি না। এখন বঙ্গবন্ধুর খুব দরকার ছিল। তিনি নিশ্চয়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এখনো লড়ে যেতেন।’
মজনুর রহমান একজন চাষি। মুক্তিযুদ্ধে মজনুর বাবা শহীদ হন। তাঁর মা মারা যান বছর পাঁচেক পর। মজনুর বয়স তখন ছয় বছর। এ সময় পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ ছিল না তাঁর। কিন্তু মাঠে বিস্তীর্ণ জমি ছিল। মজনুর কেউ না থাকার সুযোগে বাবার রেখে যাওয়া দেড়শ বিঘা জমি মানুষ জলিয়াতি করে ভোগ দখল করে নেয়। কথা প্রসঙ্গে মজনু বলছিলেন, ‘এখন তো দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। সবাই আওয়ামী লীগ। তারা মুখে মুখে সব সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা বললেও আসলে তাদের তা লালন করতে দেখা যায় না। বরং তারা শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা বিক্রি করে নিজের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত থাকে। তবে কখনো যদি বঙ্গবন্ধুর চেতনা বাস্তবায়িত হয়, সেদিন দেশ সত্যিই সোনার বাংলা হয়ে উঠবে।’
রাজধানীর একটি স্কুলের শিক্ষক মনির হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, বঙ্গবন্ধুর চিন্তা বা আদর্শ এ দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে। এবং তাঁর চিন্তাকে বিক্রি করে রাজনীতি করা হচ্ছে। যদিও আমি এমন মানুষ দেখেছি, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে তা পালন করার চেষ্টাও করে। সেজন্য অবশ্য তাকে হেনস্তার শিকারও হতে হয়।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি অন্য সেক্টরের কথা না বলে পুলিশের কথা বলি। পুলিশ এখন অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ। রাষ্ট্রের অনেক কাজে তারা অবদান রেখে চলেছে। তবে পুলিশে থেকেও এখনো অনেকে দুর্নীতি করে, অপকর্ম করে। এই সংখ্যা একেবারেই কম, তাও আমি বলব না। তবে আস্তে ধীরে তা একদিন পরিবর্তন হবে। আর বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক আদর্শের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে তাঁর আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাতে হলে এখনো সময় লাগবে বাংলাদেশের।’
নাসির হোসেন একজন রিকশাচালক। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের লোকজন অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চায় না। ভোট নিয়ে তো কথা বলতেই দেয় না। তারা যা করে, তাই মেনে নিতে হয়। জাতির জনকের দল আওয়ামী লীগ। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর চেতনার দুর্নাম করছে এরা।’
রিকশাচালকের প্রসঙ্গ তুলে বর্তমান নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের কাছে গণতান্ত্রিক পরিবেশের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তারপর কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র ছিল না বললেই চলে। তারপর একটা সময় আবার গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের মানসিকতা বদলায়নি। বাংলাদেশে একটি মত বা বিশ্বাসের লোকজন আরেকটি মত বা বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক পরিবেশ ঠিক রাখতে কিন্তু সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর যত দিন পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের হাতে গণতন্ত্র না থাকে, তত দিন তা সুরক্ষিত না। সেদিক থেকে বাংলাদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে। আসলে গণতান্ত্রিক চিন্তা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা বাস্তবায়ন করতে হলে এখনো কিছুটা সময় আমাদের লাগবে। আমার মনে হয়, আমরা সে পথেই রয়েছি।’
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভাইরোলজিস্ট) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে বড় দুটি রাজনৈতিক দল আছে। কিন্তু কোনো দলের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা চিন্তা-চেতনা তেমন একটা দেখা যায় না। আজকাল টকশোতে দেখি বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের লোকজনই একে অপরকে স্বৈরশাসক বলছেন। অথচ, এরাই কিন্তু একযোগে স্বৈরশাসক এরশাদকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছিল। তাহলে কী দাঁড়াল? এক স্বৈরশাসককে নামিয়ে আরো দুই স্বৈরশাসকের জন্ম হলো? তাহলে কি বাংলাদেশের কেউ গণতন্ত্র পছন্দ করে না, নাকি আমরা গণতন্ত্রের যোগ্য না? বঙ্গবন্ধু অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এখন তো চারদিকে অপরাধী আর অপরাধী। তবে হ্যা, এখনো অনেক রাজনীতিবিদ বা সাধারণ মানুষ আছে, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করার চেষ্টা করে, যারা দেশের মঙ্গল চায়, যারা অন্তত অপরাধে জড়াতে চায় না।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পরও পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। তারা আমাদের শোষণ-বঞ্চনা করত। ফলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এবং জয়লাভ করেছিলাম। কিন্তু এখন অনেকেই বলেন, গণতন্ত্র নিখোঁজ হয়ে গেছে। গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। আমরা তা খোঁজার চেষ্টা করছি। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। দুর্নীতির অবস্থা বুঝে তিনি তাঁর নিজের কম্বলটিও জনসম্মুখে খোঁজ করেছিলেন। আর এখন আমরা দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি না। মুখে বলি সুষ্ঠু ভোটের কথা। আসলেই কি ভোটার সুষ্ঠু ভোট দেখে? মানে, আমরা যা বলি, তা করি না। এই যখন অবস্থা তখন কেউ কেউ বলেন, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। সব মিলিয়ে আমার মনে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা বা আদর্শ থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে আছি।’