মার্চজুড়ে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড-বিস্ফোরণ, ধ্বংসলীলার শেষ কোথায়?
দেশে প্রতিনিয়তই ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এতে পাল্লা দিয়ে লম্বা হচ্ছে মৃতের তালিকা। কল-কারখানা, দোকানপাট, গুদাম পুড়ছে হরদম। বাদ যাচ্ছে না ভবন। বিভিন্ন সময় পুড়ে অঙ্গার হয়েছে গবাদি পশুও। বিশেষ করে চলতি মার্চ মাসের মাত্র ১৩ দিনে ঘটে গেছে বড়-বড় অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা। এতে ক্ষতির পরিমাণও ব্যাপক। সবকিছু হারিয়ে অনেকে হয়েছে নিঃস্ব, জীবনযাপন করছেন মানবেতর। এর শেষ কোথায়, এমনটাই প্রশ্ন এখন ঘুরছে জনমনে।
কুনিপাড়া বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড
চলতি মাসের শুরু থেকেই শুরু হয়েছে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা। শেষ ঘটল গতকাল সোমবার (১৩ মার্চ) রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার কুনিপাড়া বস্তি। সন্ধ্যার এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে লেগে যায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট কিংবা গ্যাসলাইন থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। এতে গৃহহীন হয়ে পড়েছে হাজারও মানুষ বলে দাবি স্থানীয়দের।
গুলিস্তানের ভবনে বিস্ফোরণ
কুনিপাড়ার অগ্নিকাণ্ডের ঠিক ছয় দিন আগে গত মঙ্গলবার (৭মার্চ) রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ক্যাফে কুইন নামের একটি ভবনে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা। এতে ২৪ জন নিহত ও প্রায় অর্ধশত আহত হন। এই বিস্ফোরণে ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের যাত্রীরাও রেহাই পাননি।
এই বিস্ফোরণে পথচারীরাও রক্ষা পাননি। আহত ও পরে নিহত হয়েছেন অনেকে। এতে ক্ষতির পরিমাণও লাগামহীন। রাজউক ভবনটিকে ঝুকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। এতে পাশের দুইটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশপাশের অন্যসব ভবনের মানুষ এখন শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে।
সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ভবনে বিস্ফোরণ
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের রোববার (৫মার্চ) ঢাকার সয়েন্স ল্যাব এলাকায় তিনতলা ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়। ১৩ জন দগ্ধ ও আহত হয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ড
রাজধানী ঢাকার সায়েন্স ল্যাবে যখন চলছিল উদ্ধার অভিযান তখন কক্সবাজারের উখিয়া বালুখালীতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুই হাজার বাড়িঘর পুড়ে যায়। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন প্রায় ১২ হাজার রোহিঙ্গা। ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত রোববার (৫ মার্চ) বিকেলে ঘটে এই ঘটনা। প্রাথমিকভাবে ক্যাম্পের একটি বাড়ির রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় ও দ্রুত তা পার্শ্ববর্তী ৯ এবং ১০ নম্বর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণার কথা জানায় উদ্ধার সংশ্লিষ্টরা। তিন ঘণ্টা পর ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
গুলশানের নিকেতন এলাকায় এসি বিস্ফোরণ
সায়েন্স ল্যাব এলাকার ঘটনার আগের দিন শনিবার (৪ মার্চ) গুলশানের নিকেতন এলাকায় এসি বিস্ফোরণে দু্জনের মৃত্যু হয় ও সাতজন আহত হয়।
সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ
শনিবার (৪ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রামের সিতাকুন্ডের কদমরসুল এলাকায় সীমা রি-রোলিং মিলের অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ছয়জন নিহত হন। আহত হন অনেকে। বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস ও প্রশাসন। সেসময় ফায়ার সার্ভিস জানায়, রোববার ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দ্বিতীয় দিনের একটানা অভিযানের পর আর কোনো হতাহত নেই ও আর কোনো বিস্ফোণের আশঙ্কা নেই এবং আগুনও পুরোপুরি নিভে গেছে।
নাটরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ২ সন্তানসহ মায়ের মৃত্যু
নাটোররে বড়াইগ্রামে ঘরে অগ্নিকাণ্ডে দুই সন্তানসহ সোমা আক্তার নামে এক গৃহবধূর মর্মান্তিক মৃত্যু হয় গত মঙ্গলবার (৭ মার্চ) রাতে। এ ঘটনায় আহত হন সোমা আক্তারের স্বামী ওলি বক্স। বড়াইগ্রাম সার্কেলের অতরিক্তি পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজিবের ধারণা ঘরে থাকা গ্যাস সিলিণ্ডার বিস্ফোরণের কারণে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায়।
বাগেরহাটে আগুনে দগ্ধ হয় ১৬ গরু
বাগেরহাটে গত বুধবার (১ মার্চ) দিনগত রাতে দগ্ধ হয় দুগ্ধ খামারের ১৬ গরু। এরমধ্যে দুটি গরু মারাও যায়। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চাপাতলা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। সেদিন খুলনা বিভাগীয় পরিচালক ডা. লুৎফর রহমান বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন বয়সের ১৬টি গরু অগ্নিদগ্ধ হয়। এতে দুটি গরু মারা গেছে। দগ্ধ গরুগুলোকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
যেমন ছিল ২০২১-২২
গত বছর ছিল অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের নানা ট্রাজেডিতে ভরা। দেশের ইতিহাসে ভয়বহ অগ্নিকাণ্ডের একটি ঘটে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। সে বছরের ৫ জুন বিএম ডিপোতে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা। ঘটনাস্থলের আশেপাশের চার বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। আশেপাশের ভবনের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। ৪৯ জন নিহত ও শতাধিক দগ্ধ হয়। এদের মধ্যে ১৩ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী নিহত হন।
ফায়ার সার্ভিসের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে সর্বমোট ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৬০১টি। অর্থ্যাৎ, গড়ে প্রতিদিন ৫৯টি।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ২০২২ সালে অগ্নিকান্ডে মোট ৯৮ জন মারা যায়। এরমধ্যে ৭২ জন পুরুষ ও ১৩ জন নারী। ১৩ জন বিভাগীয় কর্মকর্তা রয়েছেন। সর্বোমোট ৪০৭ জন আহত হয়। এদের মধ্যে ৩০৩ জন পুরুষ এবং ৭২ জন নারী।
আগুনের উৎসসমূহ
গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজার ও সাইন্সল্যাব এলাকার ভবনের বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে গ্যাসের পাইপ ছিদ্র বা লিকেজ হয়ে আবদ্ধ স্থানে জমে থাকাকে প্রাথমিকভাবে দ্বায়ী করেছে ফায়ার সার্ভিস। যদিও গুলিস্তানের ঘটনায় পাইপের লিকেজ দায়ী নয় বলে মন্তব্য করে তিতাস কর্তৃপক্ষ। গত রোববার (১২ মার্চ) সংস্থাটির জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং দক্ষিণ) শামসুদ্দিন আল আজাদের নেতৃত্বে ১৮ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ‘তিতাসের গ্যাস থেকে ভবনে বিস্ফোরণ হয়নি।’
যদিও বিভিন্ন সময়ে জমে থাকা গ্যাস, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, মশার কয়েলের আগুন, চুলা (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা) ইত্যাদি থেকে আগুনের ঘটনার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।