রায় শুনে কাঁদলেন পাপিয়া
নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ও তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান সুমনের বিরুদ্ধে করা অস্ত্র মামলার দুটি ধারায় ২৭ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অস্ত্র মামলায় উভয়কে ২০ বছর করে এবং গুলি মামলায় সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আজ সোমবার ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এই রায় দেন। এর আগে দুপুর ১১টা ৩০ মিনিটে কারাগার থেকে তাঁকে আদালতে হাজির করে পুলিশ।
আজ দুপুর ২টার দিকে আদালতের এজলাসের কাঠগড়ায় পাপিয়া দম্পতিকে রাখা হয়। রায় উপলক্ষে বিচারকক্ষে আইনজীবী, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। পরে ২টা ২৫ মিনিটের দিকে রায় ঘোষণা করেন বিচারক। রায় ঘোষণার পরেই কাঠগড়ায় থাকা পাপিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন। তবে এ সময় তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান সুমন ছিল নীরব। রায়ের আগে বা পরে তাঁরা কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। পুলিশ রায়ের পরই তাঁদের দ্রুত প্রিজনভ্যানে করে নিয়ে যায়।
এর আগে আদালতের সরকারি কৌঁসুলি তাপস কুমার পাল জানিয়েছিলেন, গত ২৭ সেপ্টেম্বর আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ সোমবার (১২ অক্টোবর) রায়ের দিন নির্ধারণ করেন।
তাপস কুমার পাল জানান, এ মামলায় পাপিয়াদের বিরুদ্ধে মোট ১২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে নয়াদিল্লি যাওয়ার সময় বহির্গমন গেট থেকে পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান (৩৮) ও ব্যক্তিগত সহকারী সাব্বির খন্দকারকে (২৯) গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হোটেল ওয়েস্টিন থেকে পাপিয়া ও তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী শেখ তায়্যিবাকে (২২) গ্রেপ্তার করা হয়।
পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পাপিয়ার ফার্মগেটের বাসা থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ২০টি পিস্তলের গুলি, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ ও ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় পাপিয়া, তাঁর স্বামী ও দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। মামলার পর তাঁদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তাঁরা এখন কারাগারে রয়েছেন।
কে এই পাপিয়া
নরসিংদী জেলা শহরের ভাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকার বাসিন্দা পেট্রোবাংলার অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক সাইফুল বারীর মেয়ে পাপিয়া। ২০০৯ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। এরপর ২০১২ সালে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে স্নাতক শেষ করতে পারেননি তিনি।
পাপিয়ার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যায় সেই সময়ের ছাত্রনেতাদের কাছে। কারো বক্তব্য, পাপিয়া ছাত্র রাজনীতিতে কখনোই সক্রিয় ছিলেন না। আবার কারো বক্তব্য, কলেজজীবন থেকেই পাপিয়া উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
যুব মহিলা লীগে পদ পাওয়ার আগেই পাপিয়া বিয়ে করেন নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমনকে।
যে কারণে গ্রেপ্তার হন
গত ২২ ফেব্রুয়ারি দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সহযোগীসহ পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান সুমনকে আটক করে র্যা ব। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, দুই লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ টাকার জাল নোট, ১১ হাজার ৪৮১ ডলার, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কিছু মুদ্রা ও দুটি ডেবিট কার্ড জব্দ করে।
এরপর তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হোটেল ওয়েস্টিন থেকে পাপিয়া ও তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী শেখ তায়্যিবাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাপিয়া গ্রেপ্তারের পরেই তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথ্য গণমাধ্যমে আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, গ্রেপ্তারের প্রায় দুই মাস আগে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর কক্ষে এক মডেল পাঠান শামীমা নূর পাপিয়া। এরপর ওই মডেল ও ব্যবসায়ীর অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ভিডিও করেন পাপিয়াসহ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। ব্ল্যাকমেইল করে ওই ব্যবসায়ী কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন পাপিয়া।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে ওই ব্যবসায়ী র্যাাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যা ব) কাছে অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য নেন র্যা বের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এরপর গোয়েন্দারা পাপিয়াসহ তাঁর সহকর্মীদের দিকে নজরদারি বাড়ান।
এরপরে রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে খোঁজখবর নিতে শুরু করে র্যা ব। র্যা বের গোয়েন্দারা পাপিয়াকে নজরদারিতে রাখার পর জানতে পারেন, পাপিয়া শুধু ওই ব্যবসায়ী নন, এমন অনেক অভিজাত লোকজনকে ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীদের ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পাপিয়া ব্যবহার করতেন বিদেশি মডেলদের। বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসতেন মডেলদের। মোটা অঙ্কের লেনদেন হতো মডেলদের সঙ্গে। মডেলদের বাংলাদেশে এনে কিছুদিন রেখে আবার পাঠিয়ে দেওয়া হতো। মডেলদের উড়োজাহাজের টিকেটের খরচসহ দিতে হতো মোটা অঙ্কের টাকা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এক মাস আগে রাশিয়ার কয়েকজন মডেল নিয়ে এসেছিলেন পাপিয়া। এরপর ইমিগ্রেশন থেকে ওই মডেলদের আটকে দেওয়া হয়। কারণ, তাঁরা বাংলাদেশে আসার নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারেননি। এরপর শামীমা নূর পাপিয়া বিভিন্ন ক্ষমতাশালীকে দিয়ে ওই মডেলদের বের করে নিতে সক্ষম হন।’
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যানবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সারওয়ার বিন কাশেম এনটিভি অনলাইনকে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, ‘পাপিয়ার বিদেশ থেকে মডেল আনার খবর আমরাও শুনেছি। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। আমরা এই মামলার তদন্তভার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। তদন্তের দায়িত্ব পেলে আমরা এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।’
হঠাৎ কেন পাপিয়াকে গ্রেপ্তার করা হলো—এমন প্রশ্নে সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘আমাদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলসহ নানা ধরনের অভিযোগ ছিল। আমাদের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তাঁর ব্যাপারে বিস্তারিত জেনেছি। এরপর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে কয়েক মাস ধরে বুক করে অবৈধ নারী, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছিলেন শামীমা নূর পাপিয়া। র্যামব বলছে, গত তিন মাসে শুধু ওই হোটেলেই পাপিয়া বিল দিয়েছেন এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। হোটেলটির বারে তিনি প্রতিদিন বিল দিতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা।