রিফাত শরীফ হত্যা : কী ঘটেছিল সেদিন?
২০১৯ সালের ২৬ জুন বুধবার সকাল ১০টা ১০ মিনিট। বরগুনা সরকারি কলেজে প্রতিদিনের মতো শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করছেন ক্যাম্পাসে। কেউ প্রাইভেট পড়ে কলেজ থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। কলেজটির আশপাশে ছোট ছোট দোকানদার ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এ সময় বরগুনা সদরের ডিশলাইনের ব্যবসায়ী মো. শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ মোটরসাইকেল নিয়ে স্ত্রীকে কলেজ থেকে নিতে আসেন। কিন্তু কলেজগেটে আসার পর স্ত্রী মিন্নি রহস্যজনকভাবে মোটরসাইকেলের কাছে এসে আবার কলেজের দিকে ফিরে যান। এ সময় রিফাত শরীফ তাঁর স্ত্রীকে গাড়িতে ওঠাতে পেছনে পেছনে যান। হঠাৎ করে কয়েকজন দুর্বৃত্ত তাঁকে জাপটে ধরে। প্রকাশ্যে মারধরের পাশাপাশি হামলাকারীরা রিফাত শরীফকে দা দিয়ে কোপাতে থাকে। হত্যাকাণ্ডের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি।
ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, হত্যাকারীরা রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে কিল-ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় তাঁর স্ত্রী মিন্নি পেছনে পেছনে হেঁটে যাচ্ছেন। কিন্তু কোপানোর সময় তিনি প্রধান আসামি মো. সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়নবন্ডকে থামানোর চেষ্টা করছেন। একপর্যায়ে রক্তাক্ত রিফাতকে রাস্তায় রেখে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
পরে রিফাত রিকশায় ওঠার পর স্ত্রী মিন্নি তাঁকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর মুমূর্ষু রিফাত শরীফকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বলেন চিকিৎসকেরা। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৩টায় রিফাত শরীফ হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পরদিন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরো পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয় মিন্নিকে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তে উঠে আসে, এ ঘটনায় রিফাতের স্ত্রী মিন্নির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ২৬ জুন ঘটনার দিন মিন্নি কলেজে যান। আনুমানিক সকাল ১০টা ১০ মিনিটে রিফাত তাঁর স্ত্রী মিন্নির সঙ্গে দেখা করতে বরগুনা সরকারি কলেজের গেটের সামনে যান। সেখানে ওত পেতে থাকা সব আসামি খুনের এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে রিফাতকে ঘিরে ফেলেন এবং অতর্কিতে ১ নম্বর আসামি নয়নবন্ড তাঁর হাতে থাকা ধারালো বগি দা (রামদা) দিয়ে রিফাত শরীফকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘাড় লক্ষ্য করে কোপ দেন। এতে রিফাতের গলার ডান পাশের হাড় ও রগ কাটা পড়ে রক্তাক্ত জখম হন। ওই সময় ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী তাঁর হাতে থাকা ধারালো দা দিয়ে রিফাত শরীফকে কোপ দেন এবং সেই কোপ রিফাতের বুকের ডান পাশে পড়লে হাড় কাটা পড়ে জখম হয়। একই সময়ে ৩ নম্বর আসামি রিশান ফরাজী তাঁর হাতে থাকা দা দিয়ে রিফাত শরীফের মাথায় কোপ দেন এবং এতে তিনি গুরুতর জখম হন। তখন অন্য আসামিরা রিফাত শরীফের শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে রাস্তায় ফেলে চলে যান। পরে স্থানীয় কিছু লোকের সহায়তায় রিফাত শরীফকে রিকশায় করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান মিন্নি। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।
বাদী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এজাহারে আরো উল্লেখ করেন, টেলিফোনে খবর পেয়ে তিনি হাসপাতালে ছুটে যান এবং ছেলের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনতে পান। পরে রিফাতের অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে হাসপাতালে রিফাতের মৃত্যু হয়।
মামলায় সাক্ষী হিসেবে রিফাত শরীফের স্ত্রী মিন্নি, আবদুস সালাম, আ. আজিজ শরীফ, মো. মনজুরুল আলম জন, মো. লিটন, আনোয়ার হোসেন মৃধা, মো. জাকারিয়া বাবু, মো. হারুন, আ. হাই আল হাদি, মো. সজলের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, মামলায় আরো সাক্ষী আছে।
নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। চারদিকে শুরু হয় প্রতিবাদ। পুলিশ পরে গত বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। তবে প্রধান আসামি নয়নবন্ড পুলিশের অভিযানের সময় ২ জুলাই ভোররাত সোয়া ৪টার দিকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
এদিকে, হত্যাকাণ্ডের একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ এবং মিন্নির সঙ্গে মামলার ১ নম্বর আসামি নয়নবন্ডের একাধিক ফোনালাপের খবর ফাঁস হলে ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। মিন্নিও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১৩ জুলাই বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নির গ্রেপ্তার দাবি জানান। পরদিন ১৪ জুলাই মিন্নি তাঁর বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, “যারা বরগুনায় ‘বন্ড ০০৭’ সন্ত্রাসী গ্রুপ করেছিল, তারা খুবই ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী। তারাই মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আমার শ্বশুরকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করিয়েছে।” ১৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের হেফাজতে নিয়ে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মিন্নিকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে হাইকোর্টের আদেশে মিন্নি জামিন পান।
আগামীকাল বুধবার এ মামলায় রায় ঘোষণা করা হবে। এর আগে ওই বছরের ৬ নভেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারের জন্য মামলাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠান সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামানের আদালতে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়। ৮ জানুয়ারি থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেন আদালত। এরপর মোট ৭৬ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সব আসামির পক্ষে-বিপক্ষে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর যুক্তি খণ্ডন শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ধার্য করেন আদালত।