সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নবম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
আজ ২০ মার্চ। নয় বছর আগের এই দিনে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যু হয়। নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর জন্মস্থান ভৈরবে দিনটি পালন করা হচ্ছে। দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—কালোব্যাজ ধারণ, প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, কোরআনখানি, মিলাদ, দোয়া ও আলোচনা সভা।
অহিংস রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ, ভাষাসৈনিক এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জিল্লুর রহমান দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তিনি মারা যান।
এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার গঠন হলে জিল্লুর রহমান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর তিনি তিন বার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ভৈরব শহরের ভৈরবপুর মহল্লার বলাকি মোল্লাবাড়িতে ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ জিল্লুর রহমানের জন্ম। তাঁর নানার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈতাতলা। জন্মের সাত মাসের মাথায় মা বাচ্চু বিবি মারা যান। আর, নয় বছর বয়সে হারান বাবাকে। তাঁর বাবা মেহের আলী ছিলেন স্বনামধন্য আইনজীবী, অবিভক্ত ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জেলা বোর্ডের সদস্য।
অনাথ ও বেদনবিধুর শৈশবে জিল্লুর রহমান বেড়ে ওঠেন দাদা হাজী মোজাফফর মুন্সী মোল্লা ও নানা-নানির আশ্রয়ে। জিল্লুর রহমান ১৯৪৫ সালে ভৈরব কেবি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে আই এ পাশ করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৫৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জিল্লুর রহমান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র সমাবেশে জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
২০ ফেব্রুয়ারিতে ফজলুল হক ও ঢাকা হলের পুকুর পাড়ে যে ১১ জন নেতার নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেখানে জিল্লুর রহমান অন্যতম নেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
১৯৫৩ সালে জিল্লুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং একই সঙ্গে তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু, প্রবল আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুনরায় তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি ফিরিয়ে দেয়।
সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন।
জিল্লুর রহমান ষাটের দশকে ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রাবস্থায় সিলেটে গণভোটের কাজ করার সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন।
১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণআন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ৬৯-এর সময় তিনি ভৈরবের জনগণের কাছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। সে সময় থেকেই তিনি ভৈরবের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠতে থাকেন।
তৎকালীন ভৈরব অঞ্চলের প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে জিল্লুর রহমানের নাম প্রচার হতে থাকে। সে সময়ে দাঁড়িপাল্লার বিরুদ্ধে নৌকা মার্কা প্রতীক নিয়ে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ১৯৭০ সালে জিল্লুর রহমান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
জিল্লুর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি মুজিবনগর সরকার পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে সময় দখলদার পাকিস্তান সরকার তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে ২০ বছর কারাদণ্ড দেয় ও তাঁর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।
দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সাবেক এ প্রেসিডেন্ট সবার কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। আর তাই ভৈরব-কুলিয়ারচরের জনগণ ওই আসনে তাঁকে ছয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেন।
মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভানেত্রী আইভি রহমান তাঁর স্ত্রী ছিলেন, যিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দলীয় জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আহত এবং ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
জিল্লুর রহমান ও আইভি রহমানের সন্তান নাজমুল হাসান পাপন বর্তমানে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি।