সুদের টাকার জেরে প্রাণ গেল স্ত্রীর, স্বামীও গ্রামছাড়া
সুদের টাকা ও বসতি জমি লিখে নিয়েও ক্ষ্যান্ত হয়নি সুদি কারবারি কায়েশ তালুকদার। ভুক্তভোগী রাখাল ভদ্রকে নির্যাতনের পর গ্রাম ছাড়া করে সুদের টাকার সূত্র ধরে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাখালের স্ত্রী পূর্ণিমার ওপর। দুই শিশু সন্তানের সামনে সম্ভ্রম হারিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে ওই গৃহবধূ পূর্ণিমাকে। এমন ঘটনা ঘটে গত ৯ এপ্রিল পটুয়াখালী জেলা শহরের অদূরে জৈনকাঠি ইউনিয়নের ভাগিরাবাদ গ্রামে।
ঘটনা আড়াল করতে নিহত পূর্ণিমার ছেলে আকাশকে দেওয়া হয়েছে প্রাণনাশের হুমকি। এরই ধারাবাহিকতায় ভিকটিম পরিবারের জমিতে সীমানা প্রাচীর দিয়ে দখলের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে।
নিহত পূর্ণিমার দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে আকাশ ভদ্র (১৫) ও পরিবার এমন রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। ঘটনার পর জড়িতরা গা-ঢাকা দিলেও এখন প্রকাশ্যে দম্ভোক্তি করছে। পাশাপাশি ঘটনা আড়াল করতে কৌশল চালাচ্ছে জড়িতরা।
পূর্ণিমার স্বামী রাখাল ভদ্র জানান, আর্থিক সংকটে ২০১৬ সালের প্রথম দিকে স্থানীয় দুলাল তালুকদারের ছেলে কায়েশ তালুকদারের কাছ থেকে দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকা সুদে ধার নেন তিনি। জামানত বাবদ কায়েশকে দেওয়া হয় একটি অলিখিত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর এবং ব্যাংকের চেক। প্রতি মাসে ৮ শতাংশ হারে টানা চার বছর সুদের ঘানি টেনে পরে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করেন তিনি। টাকা পরিশোধের পর চেক ও ট্যাম্প ফেরত চাওয়া হলে টালবাহানা শুরু করেন কায়েশ। একপর্যায় রাখালের বাড়ি ও জমি লিখে দিতে প্রভাবিত করে কায়েশ। এতে রাখাল আপত্তি জানালে সেহাকাঠি বাজারে প্রকাশ্যে মারধর করে নীরব থাকার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। রাখালকে নানা হুমকি দিয়ে খালাতো ভাই আব্দুল বাসেদের নামে ২৪ শতাংশ, বোন জামাই রবের নামে ২১ শতাংশ এবং নিজের নামে ছয় শতাংশসহ মোট ৫১ শতাংশ জমি লিখে নেন কায়েশ।
লিখে নেওয়া ওই জমির দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে কায়েশ গং। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জৈনকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের পেছনে নিয়ে রাখালকে মারধর করে গ্রাম ছাড়তে বলা হয়। নির্যাতনের তিন দিনের মাথায় বাড়ি ছাড়েন রাখাল। তাঁর অবর্তমানে কায়েস রাখালের স্ত্রীকে নানা ভাবে হয়রানি করে। সুদের টাকার সূত্র ধরে কায়েস গং তাঁর স্ত্রীকে নির্যাতন করে হত্যা করেছেন। পরিবারের দেওয়া খবরে আমি পিরোজপুর থেকে রওনা দিয়ে আসতে দেড়ি হয়। পটুয়াখালী পৌছে সদর থানার অবহিত করে এসআই শামীমকে নিয়ে বাড়ীতে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে পোস্টমর্টেম সম্পন্ন করি এবং ধর্মীয় মতে মুখাগ্নি করে মাটি চাপা দেই।
রাখালের বোন শোভা রানী বলেন-স্বামীর অবর্তমানে পূর্ণিমাকে উত্ত্যক্ত শুরু করে কায়েশ গং। যখন-তখন লোকজন নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়ে হুমকি-ধমকি দিত। মোবাইল ফোনে যৌন প্রস্তাবসহ বলা হয় নানা অশ্লীল কথাবার্তা। গভীর রাতে ঘরের চালায় ঢিল ছুঁড়ে, দরজায় ধাক্কা দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করত। উত্ত্যক্ত থেকে রেহাই পেতে প্রতিরাতে পূর্ণিমা আশ্রয় নিত বাড়ির অন্য ঘরে। কায়েশ সোর্স তৈরি করে সেখানে পৌঁছে যেত। ঘটনার দিন ৮ এপ্রিল পূর্ণিমা রাতে ঘুমাতে যান মনিকার ঘরে। মধ্যরাতে দুই বছরের শিশু কন্যা পূজার কান্না থামাতে নিজের ঘরে আসেন। এরপর দুই সন্তানকে মাঝখানে নিয়ে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।
নিহত পূর্ণিমার ছেলে আকাশ ভদ্র জানায়, ৯ এপ্রিল দিবাগত রাত ৩টার দিকে ঘরের পেছনে টিনের শব্দ শুনে তাদের ঘুম ভাঙে। পরে দেখে গলায় কাপড় মুড়ানো অবস্থায় তার মা মাটিতে পড়ে আছেন। তার মায়ের গলায়, কপালে রক্তাক্ত জখম, বাম বাহু এবং হাঁটুর নিচে আঘাতের চিহ্ন ছিল। ঘুম ভাঙার পর শব্দ শুনে ধারণা হয়েছে তিন-চারজন লোক ঘর থেকে দ্রুত বের হয়েছে।
রাখালের বৃদ্ধা মা সরস্বতী রানী বলেন-শব্দ শুনে চোখ মেলে দেখি পাঁচ-ছয়জনকে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যেতে। কিন্তু অন্ধকারে কাউকে চিনতে পারিনি। পরে দেখি ছেলের বউ মাটিতে পড়ে আছে। পরে সবাইকে জানাই। পোস্টমর্টেমে দায়িত্বরত দুই চিকিৎসক বলেন-নিহত পূর্ণিমার কপালে রক্তাক্ত জখম, বাম বাহু এবং হাটুর নিচে আঘাতের চিহ্ন। যৌন নির্যাতন হয়েছে কি না, তা এই মুহূর্তে বলার সুযোগ নেই। রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। রাখালের ভাতিজা সুমন ভদ্র বলেন-এত কিছুর পরও কায়েশ গং আমাদের বাড়ির সামনে বিশাল দাগের পিলার পুতে জমির সীমানা দিয়েছে দখল নেওয়ার জন্য। এর আগে কায়েশ আমার কর্মস্থল আমতলিতে গিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসে।
পূর্ণিমার পরিবার আরও জানায়, ৯ এপ্রিল লাশ উদ্ধার করে ১০ এপ্রিল পোস্টমর্টেম করেছে। ফলে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জৈনকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আলম বলেন, রাখাল আমার এনজিওতে কর্মরত ছিল। সরল এবং বিশ্বস্ত ছিল সে। লোকমুখে এমন ঘটনা শুনে ঘটনাস্থলে আসি। কিন্তু ভিকটিম পরিবারের মুখে ভয়ের ছাপ দেখতে পাই। এলাকাবাসী বলছে, ঘটনার পরপর কায়েশ এলাকায় ছিল না। ১৩ এপ্রিল বাড়িতে এসে বলে বেড়ায়, এতে কী হবে—দেখা যাবে?
এ প্রসঙ্গে অভিযুক্ত কায়েশ তালুকদার বলেন, ‘উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নই। টাকা দিয়ে জমি কিনেছি।’
মরদেহ উদ্ধারকারী সদর থানার এসআই শামীম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও তাঁর প্রস্তুত করা লাশের সুরতহাল রিপোর্টে কয়েকটি স্থানে জখমের চিহ্ন এবং যৌনাঙ্গ রক্তাক্ত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল খান মোহাম্মদ মুকিত হাসান বলেন, ভিকটিম পক্ষ পুলিশকে এভাবে অবহিত করেনি। যাই হোক, আমরা বিষয়টি নতুন ভাবে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, হত্যার বিষয়টি তিনি শুনেছেন এবং গুরুত্বসহ তদন্ত করা হবে।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ এবং জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পূর্ণিমার আলোচিত মৃত্যুর সঙ্গে যুক্তদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।