সৌদি আরবে শত যুবকের বন্দিজীবন, ফিরিয়ে আনার আকুতি স্বজনদের
সৌদি প্রবাসী দুই ভাইয়ের ফাঁদে পড়ে ভুয়া ভিসায় সৌদি আরব গিয়ে বন্দিজীবন যাপন করছেন কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের একটি গ্রামের প্রায় একশ যুবক। কাজ-রোজগার না থাকায় খাওয়া নেই, নাওয়া নেই। দুশ্চিন্তায় চোখে নেই ঘুম। মরুর নির্জন এলাকায় পরিত্যক্ত একেকটি কক্ষে ১৫ থেকে ২০ জন গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে ৮/৯ মাস ধরে। কক্ষগুলোতে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। তীব্র গরমে গুহার মতো এসব কক্ষে চরম কষ্টে দিন পার করছেন তারা। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর নেমে আসছে অত্যাচার। হুমকি দেওয়া হয় মেরে মরুভূমির ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার।
এসব কষ্টের বর্ণনা দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ওই যুবকদের আকুতির একটি ভিডিওবার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। দেশে ফিরতে না পারলে তাদের লাশও ফিরে পাওয়া যাবে না বলে জানান তারা। দেশে ওই যুবকদের পরিবারে নেমে এসেছে সীমাহীন উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর দুঃখ-দুর্দশা। ঋণের চাপ, পরিবারের সদস্যদের রোজকার ভরণপোষণ আর প্রিয়জনদের কর্মহীন বন্দি প্রবাসজীবন তাদের দুঃসহ যন্ত্রণায় ফেলেছে।
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার রামদি ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের দুই ভাই মান্নান ও হান্নান। বড়ভাই মান্নান ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে সৌদি আরবে আছেন। ছোট ভাই হান্নান থাকেন দেশে। অভিযোগ এই দুই সহোদরের বিরুদ্ধে। তাদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে ওই গ্রামের শত দরিদ্র পরিবার এখন অথৈ জলে ভাসছে। ধার-কর্জ ও সুদের টাকায় সুখ আর স্বচ্ছলতার আশায় পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিটিকে প্রবাসে পাঠিয়ে এখন হয়েছেন নিঃস্ব। ঋণের দায় আর পরিবারের ভরণপোষণ নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। সন্তানদের শিক্ষা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অবস্থা হয়েছে শিশু আর বৃদ্ধদের।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানায়, পাঁচ লাখ টাকায় সৌদি আরব গেলে মাসে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বেতন। দুই বছরে একবার দেশে ছুটি কাটিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। এতো টাকা বেতনে চাকরি করলে সংসারের অভাব অনটন দূর হবে, এমন লোভ দেখিয়ে, রীতিমত নির্বাচনি প্রচারণার মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিম্নআয়ের দরিদ্র মানুষদের ‘সুখের স্বপ্ন’ দেখিয়ে রাজি করায় ছোট ভাই হান্নান। তাদের টার্গেটের কেউ দ্বিমত করলে সৌদি আরবে থাকা বড় ভাই মান্নান ওই ব্যক্তিকে মোবাইলে নানান প্রলোভন আর আশ্বাসে তাদের লোভের ফাঁদে ফেলে। ভিসার জন্য শুধু তারাকান্দি গ্রাম থেকে ৯৫ জন দরিদ্র কৃষিশ্রমিক, অটোরিকশাচালক, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, খামারি, মুদি দোকানির কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নেওয়া হয় আর অন্যান্য খরচের কথা বলে নেওয়া হয় আরও ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।
গ্রামের এইসব হতরিদ্ররা তাদের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন এনজিওসহ গ্রাম্য সুদিমহাজনদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে এই বিশাল অংকের টাকা তুলে দেয় হান্নানের হাতে।
একই সময়ে হান্নান স্থানীয় বাজরা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অফিস খুলে রামদি, সালুয়া, গোবরিয়া, লক্ষ্মীপুর, জাফরাবাদ, আগরপুর, বাগপাড়া, দোয়ারিয়া, ভবানীপুর, সাল্লা গ্রামসহ পাশের উপজেলা বাজিতপুর ও কটিয়াদি থেকে আরও তিনশর মতো লোককে সংগ্রহ করে সৌদি আরব পাঠান। সৌদি আরব যাওয়ার পর সাত দিনের মধ্যে আকামাসহ কাজে যোগদানের কথা থাকলেও, দিনের পর দিন কেটে গেছে, আকামা বা কাজের কোনো ব্যবস্থা না হওয়ার কথা দেশে স্বজনদের জানালে চাপের মুখে হান্নান লুকিয়ে সৌদি আরব চলে যায়।
প্রবাসীদের স্বজনেরা জানায়, সৌদি আরবে গিয়ে কেন দেশে আত্মীয়দের কাছে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানালো-এই অভিযোগে হান্নান কয়েকজনের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালান। একই সময় তাদের খাবার-দাবারও বন্ধ করে দেন।
স্বজনেরা আরও জানান, ৮ থেকে ৯ মাস ধরে তারা তাদের লোকজনদের দেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। এতে করে প্রতি পরিবারের আরও ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা করে পাঠানো হয়ে গেছে। যাওয়ার সময়কার ঋণ, ঋণের সুদ, পরিবারের খরচ-ইত্যাদির চাপে তারা দিশেহারা। সরকারের কাছে তাদের দাবি, অবিলম্বে স্বজনদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক।
পাশাপাশি তারা দালাল হান্নান-মান্নানের কাছ থেকে তাদের ক্ষতিপুরণ আদায়সহ অন্যায় অত্যাচার ও জুলুমের শাস্তির দাবি জানান।
এদিকে স্বজন ও প্রবাসীদের অভিযোগ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে সৌদি আরবে থাকা হান্নানের এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি এনটিভিকে বলেন, ‘এলাকার দরিদ্র লোকদের স্বচ্ছলতা ফেরাতে এবং অনুন্নত গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে ৯৫ জন নয়, ৭২ জনকে সৌদিতে এনেছি। সৌদি আরবের বর্তমান শ্রমবাজার মন্দা থাকায় ১৫ থেকে ২০ জন লোকের কাজ দিতে পারিনি। তাদেরকে আকামাসহ কাজে নিয়োগের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
কুলিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া ইসলাম লুনা বলেন, ‘এইমাত্র বিষয়টি জানতে পারলাম। এ পর্যন্ত কেউ লিখিতভাবে জানায়নি বিষয়টি। এটি যেহেতু একটি আইনি বিষয়, খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে কুলিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি)।’