হবিগঞ্জে তরুণী হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন, আসামির দায় স্বীকার : পিবিআই
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বড়ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়নের বাগাউড়া গ্রামে ধানখেত থেকে গলাকাটা অবস্থায় রীমা বেগম (১৭) নামের (ছদ্মনাম) এক তরুণীর লাশ উদ্ধারের রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে বলে দাবি করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই-এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুই হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে প্রধান হত্যাকারী খলিল উদ্দিন (২০) আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক-এর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তিনি। হবিগঞ্জের আদালত পরিদর্শক আনিছুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, গত ২৭ ডিসেম্বর সকালে নবীগঞ্জ থানা পুলিশ হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় স্কুলছাত্রী রীমার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে। উপজেলার হরিনগর গ্রামের একটি টাওয়ারের পাশের ধানখেত থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসপি) আবুল খায়ের চৌধুরী, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ডালিম আহমদসহ একদল পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে লাশের সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়।
এ ব্যাপারে নিহত রীমার বাবা সুফি মিয়া বাদী হয়ে ২৮ ডিসেম্বর অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর হওয়ায় হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের নির্দেশে হবিগঞ্জ পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তভার পেয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আহাদ পিবিআই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিদের্শনায় তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করেন। পিবিআই-এর পরিদর্শক আব্দুল মুক্তাদির দুজনকে আটকের তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আটক দুজন হলেন—নিহত রীমার প্রেমিক হরিনগর গ্রামের বাসিন্দা এবং বাসের হেলপার খলিল উদ্দিন (২০) ও একই গ্রামের সবজি বিক্রেতা গোলাম হোসেন (৪৫)। তাঁদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর পিবিআই পুলিশের কাছ থেকে ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তি দেন খলিল। পরে প্রেমিক খলিল উদ্দিন বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
জিজ্ঞাসাবাদে আসামিদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পিবিআই জানায়, আসামি খলিল উদ্দিন ও ভুক্তভোগী রীমার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বাগাউড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী ছদ্মনাম রীমা বেগম পরিচয়ে খলিল উদ্দিনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল। আসামি গোলাম হোসেন রীমার মোবাইল নম্বর খলিলকে দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে খলিল ও রীমার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। ঘটনার আনুমানিক ১৫ দিন আগে ঘটনাস্থলেই মধ্যরাতে রীমার সঙ্গে খলিল দেখা করতে আসেন। তখন তাঁদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও হয়। ঘটনার আগের দিন রীমা অসুখের কথা বলে খলিলের কাছে টাকা ধার চায়। তখন খলিল দুই হাজার টাকা রীমাকে দেবেন বলে জানান। রাতে দেখা করে টাকা নিতে বলেন। সন্ধ্যায় আসামি গোলাম হোসেনের সঙ্গে খলিলের দেখা হয়। তখন খলিল রীমার সঙ্গে রাতে দেখা করতে যাওয়ার বিষয়টি গোলাম হোসেনকে জানালে তিনি খলিলের সঙ্গে যাওয়ার জন্য ইচ্ছার কথা জানান। খলিল ও গোলাম হোসেন ২৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১টার দিকে ঘটনাস্থলে যান। কিছুক্ষণ পর রীমা ঘটনাস্থলে গিয়ে খলিলের সঙ্গে দেখা করে। ওই সময় গোলাম হোসেন একটু দূরে আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। একপর্যায়ে উভয়ের মধ্যে দৈহিক মেলামেশা হয়। তাঁদের শারীরিক সম্পর্ক শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোলাম হোসেন ঘটনাস্থলে গিয়ে রীমার সঙ্গে দৈহিক মেলামেশার জন্য জোর-জবরদস্তি শুরু করেন। কিন্তু রীমা বাধা দেয়। তখন খলিল গোলাম হোসেনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে রীমাকে অনুরোধ করেন খলিল। তাতেও রীমা রাজি না হলে গোলাম হোসেন রীমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তারই ওড়না দিয়ে হাত বাঁধেন এবং গলা পেঁচিয়ে ধরেন। রীমার গলায় পেঁচানো ওড়নার একদিকে গোলাম হোসেন ও অন্যদিক খলিল ধরে টান মেরে রীমার শ্বাসরোধ করেন। ওই সময় রীমা ছটফট করে মাটিতে পড়ে গিয়ে গোঙাতে থাকলে আসামিরা তাদের সঙ্গে থাকা ব্লেড দিয়ে গলাকেটে রীমাকে হত্যা করে ঘটনাস্থলে ফেলে পালিয়ে যান।
বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়নের বাগাউড়া গ্রামের দিনমজুর সুফি মিয়ার মেয়ে স্কুলছাত্রী রীমা ২৬ ডিসেম্বর রাতে পরিবারের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েন। ভোর রাতে সুফি মিয়া ঘুম থেকে উঠে মেয়েকে ঘরে না দেখে খোঁজ করেন। এর মধ্যে গত ২৭ ডিসেম্বর সকালে স্থানীয় লোকজন ওই ছাত্রীর গলাকাটা লাশ হরিনগর এলাকায় ধান খেতে পড়ে থাকতে দেখেন। খবর পেয়ে নবীগঞ্জ থানার ওসি মো. ডালিম আহমদের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে। এ সময় নিহত ছাত্রীর ছোট বোন জানায়, ঘটনার দুদিন আগে মোবাইল ফোনে নিহত রীমাকে অজ্ঞাত লোকের সঙ্গে রাগান্বিত হয়ে কথা বলতে দেখেছে এবং একে-অপরের মধ্যে উত্তপ্ত গালমন্দ হয়েছে। হরিনগর গ্রামের খলিল উদ্দিনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল নিহত রীমার। স্থানীয়দেরও ধারণা ছিল, প্রেমঘটিত কারণেই ওই প্রেমিক অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের সহায়তায় রীমাকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে গলা কেটে হত্যা করে।
এলাকাবাসীর এমন ধারণার সূত্র ধরেই পুলিশ ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। এ ব্যাপারে নিহত রীমার বাবা সুফি মিয়া বাদী হয়ে নবীগঞ্জ থানায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর হওয়ায় হবিগঞ্জ পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম মুরাদ আলি মামলাটি হবিগঞ্জ পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তদন্তভার পেয়ে হবিগঞ্জের পিবিআই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনসহ ঘাতকদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।
এদিকে এলাকাবাসী অসহায় দিনমজুরের মেয়ে মেধাবি স্কুলছাত্রী রীমার হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। বুধবার বিকেলে স্থানীয় কাজিরগঞ্জ বাজারে ওই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।