৭ স্থানে ডুবোচর : দৌলতদিয়ায় আটকে আছে কার্গো জাহাজ
রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী নৌপথে নাব্য সংকটের কারণে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে আসা ৩৫টি পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ দৌলতদিয়া ঘাটের কাছে আটকে আছে। দৌলতদিয়ার জয়পুর, মানিকগঞ্জের মোল্যার চর, কানাইদা, চরলতিফপুর, পাবনার নগরবাড়ী, নাকালিয়া ও মোহনগঞ্জ এলাকায় ডুবোচরের কারণে পণ্যবাহী কার্গো সরাসরি বাঘাবাড়ী পৌঁছাতে পারছে না।
বিদেশ থেকে আমদানীকৃত পাথর, কয়লা, গম, সারসহ বিভিন্ন পণ্য জাহাজে করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে আসে। সেখান থেকে কার্গো জাহাজ বোঝাই করে এসব পণ্য বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে রওনা করে দৌলতদিয়ায় এসে বিরতি দিচ্ছে। তবে নাব্য সংকটের কারণে কিছু পণ্য এখান থেকে খালাসের পর চলাচলের উপযোগী করে তবে বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ এ সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং এক সপ্তাহ ধরে পণ্যবাহী জাহাজগুলো আটকে আছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা কার্যালয় জানায়, চট্টগ্রাম থেকে দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত নৌপথের দূরত্ব ৩৭০ কিলোমিটার। দৌলতদিয়া থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত নৌপথের প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব। এর মধ্যে দৌলতদিয়া থেকে পাবনার নগরবাড়ীর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। নগরবাড়ী থেকে বাঘাবাড়ীর দূরত্ব আরো ২০ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি বাঘাবাড়ী পর্যন্ত নৌপথের প্রায় ৪২০ কিলোমিটার দূরত্ব। এই নৌপথ দিয়ে চট্টগ্রাম বা মোংলা থেকে আসা এসব কাঁচামাল বা জরুরি পণ্য বাঘাবাড়ী পৌঁছাতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ দিন। নৌপথের ছয়-সাতটি স্থানে ডুবোচর জেগে ওঠায় সরাসরি যেতে না পেরে তিন দিনে দৌলতদিয়ায় পৌঁছে পণ্য খালাসের জন্য আরো কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যে কারণে এসব পণ্য বাঘাবাড়ী পৌঁছাতে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে।
গত ২১ নভেম্বর সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দৌলতদিয়ার ৬ নম্বর ফেরিঘাটের অদূরে বাহিরচরে ৩৫টির মতো কার্গো-জাহাজ নোঙর করে রয়েছে। জাহাজ মাস্টার, ড্রাইভার, সুকানিসহ অন্যান্য স্টাফ ঘোরাফেরা করছেন। এসব কার্গোতে পাথর, কয়লা, সার ও গম রয়েছে। ১৫০ জনের মতো শ্রমিক জাহাজ থেকে এসব পণ্য বলগেটে খালাসের কাজ করছেন।
পাথর ও কয়লা দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে আমদানি করা। পাথর ও কয়লা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাবনার নগরবাড়ী যাবে। সেখান থেকে ঈশ্বরদী হয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাবে। সার ও গম বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়।
এ সময় এমভি নাফিজ-১, এমভি গোলাপ-৪, এমভি সোলার জেট, এমভি সাথী ভাই-২, এমভি সামিন-সোহেল-১, এমভি সোবহান-১, এমভি সোনিয়া-৭, এমভি প্রিন্স মিম, এমভি সনজিদ, এমভি সাদি বেঙ্গল, এমভি গোল্ডেন রোজ, এমভি কুইন অব ফিরোজা-২, এমভি মশিউর সামিয়া, এমভি নুসরাত ইসলাম, এমভি আরাফাত ময়দান, এমভি শাহারাস্তি-২, এমভি আনিকা সামিহা, এমভি ওয়াফি, এমভি খিজির তরী, এমভি প্রিন্স অব সোবহান, এমভি নাফিজ-২, এমভি আসাদ-১, এমভি আনিশা, এমভি গ্লোবালিজ-২, এমভি সামিরা গোলাপ, এমভি ওয়ারিশা আহনা, এমভি সুলতানা মান্নানসহ ৩৫টির মতো কার্গো নদীতে ভাসতে দেখা যায়। এক সপ্তাহ ধরে অধিকাংশ জাহাজ এখানেই অপেক্ষা করছে।
জাহাজ এমভি নাফিজ-১-এর সুকানি (চালক) রোকন উজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে এক হাজার ৩০০ টন গম বোঝাই করে এক সপ্তাহ আগে বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে রওনা করে গত সোমবার দৌলতদিয়ায় এসে পৌঁছান। এখানে অন্তত ৪০০ টন গম খালাসের পর ড্রাফট কমে এলে বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে রওনা করবেন। তার আগে আরো অনেক জাহাজ এসে এখানে অবস্থান করছে। নাব্য সংকট দূর করতে দ্রুত খননকাজ শুরু না করলে আরো খারাপ পরিণত হবে।
এমভি প্রিন্সেস মিমের মাস্টার আবদুল হান্নান বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে প্রায় এক হাজার ১০০ টন পাথর নিয়ে পাবনার নগরবাড়ীর উদ্দেশে রওনা করে গত ১৫ নভেম্বর দৌলতদিয়ায় এসে আটকে আছি। এখান থেকে কমপক্ষে ১৫০ টন পাথর নামানোর পর যেতে পারব। ২২ নভেম্বর দুপুরে পাথর খালাসের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এখনো আরো দুদিন থাকতে হবে। জাহাজের ১৩ জন স্টাফদের পেছনে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়। এসব টাকা ব্যক্তিগতভাবে খরচ হয়। অথচ সরাসরি জাহাজ যেতে পারলে কোম্পানি আরো বেশি পণ্য ট্রিপ দিতে পারত।’
পণ্য খালাসের জন্য দৌলতদিয়া ঘাটে শ্রমিক জোগানের দায়িত্বে থাকা মেসার্স আরিফ ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড কমিশন এজেন্টের ব্যবস্থাপক মনির উদ্দিন সরদার বলেন, তিনটি গ্রুপে ১৫০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করছে। অধিকাংশ শ্রমিক নগরবাড়ী থেকে এসেছে। নাব্য স্বল্পতার কারণে এক সপ্তাহ ধরে এখানে জাহাজ ভিড়ছে। শ্রমিক সংকট থাকায় ১৯ নভেম্বর থেকে পণ্য খালাস শুরু হয়। প্রতিদিন গড়ে ছয়-সাত হাজার বস্তা খালাস করতে পারে। আর কিছুদিন পর জাহাজ বেড়ে গেলে শ্রমিক স্বল্পতার কারণে সমস্যা বেড়ে যাবে। প্রতি বস্তা মাল থেকে ট্রান্সপোর্টকে তিন টাকা করে দেয়। এর মধ্যে শ্রমিকদের দিতে হয় বস্তাপ্রতি দুই টাকা ৬০ পয়সা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক (নৌসপ) আবদুর রহিম বলেন, অক্টোবর মাসের শেষের দিক থেকে নাব্য সংকট দেখা দেয়। দৌলতদিয়া থেকে বাঘাবাড়ীর ৫০ কিলোমিটার নৌপথের ছয়-সাতটি স্থানে ডুবোচর ওঠায় সরাসরি জাহাজ যেতে পারছে না।
আবদুর রহিম বলেন, বর্তমানে পানির গভীরতা রয়েছে সাত-আট ফুট। পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য প্রয়োজন ১১ ফুট। নাব্য সংকট দূর করতে ইতোমধ্যে বিআইডব্লিউটির নিজস্ব দুটি ড্রেজার (খননযন্ত্র) আনা হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে খনন করে দুই ফুট করে গভীরতা বাড়লে ও কিছু পণ্য খালাসের পর ৯ ফুট করে পানি পেলে জাহাজ যেতে পারবে। এ ছাড়া আগামী বছরের মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ সমস্যা থাকতে পারে বলে জানান তিনি।