স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুলিশ ফাঁড়ি
পাবনার বেড়া উপজেলার প্রত্যন্ত ঢালারচর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি এখন পুলিশ ফাঁড়ি। ফলে ইউনিয়নের ২৫ হাজার মানুষ নয় বছর ধরে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ২৬ লাখ টাকা ব্যয় করে নির্মাণ করা হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। দুর্গম ও জনবিচ্ছিন্ন ইউনিয়নবাসীর জন্য এটিই ছিল স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার একমাত্র ভরসা। কিন্তু ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র সাতদিনের কথা বলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হলেও তা আজ পর্যন্ত বহাল আছে। কিন্তু যেদিন থেকে পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হয়, সেদিন থেকেই এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় জানায়, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে মূলত মা ও শিশুরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা পেলেও সবার জন্যই এটি উন্মুক্ত ছিল। বেড়া উপজেলায় এমন স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে চারটি। এর মধ্যে ঢালারচর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রটির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। নবনির্মিত দ্বিতল এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শুধু মা ও শিশুরাই নয়, চরাঞ্চলের সাধারণ রোগীরাও স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে আসছিল।
বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কার্তিক চন্দ্র সাহা জানান, ২০০৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মাত্র সাতদিনের কথা বলে বেড়া পুলিশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে অবস্থান নিয়ে এখনো সেখানে রয়ে গেছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা জায়গা না পেয়ে সেখানে বসতেই পারছেন না। তবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির পাশের একটি বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের কার্যক্রম কিছুটা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আরো জানান, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে একাধিকবার লিখেছেন। তা ছাড়া উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভাতেও বিষয়টি তিনি কয়েকবার তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকায় শুধু পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমই ব্যাহত হচ্ছে না, স্বাস্থ্যসেবাও ব্যাহত হচ্ছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের আওতাধীন হলেও সেটি মুক্ত থাকলে সপ্তাহে অন্তত দুদিন সেখানে একজন মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করানো যেত।’
সরেজমিনে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একজন উপপরিদর্শক (এসআই), দুজন সহকারী উপপরিদর্শকসহ (এএসআই) ২৪ পুলিশ সদস্য অবস্থান করছেন। বর্তমানে এটি অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) হামিদুল ইসলাম জানান, সন্ত্রাসকবলিত এ এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে তাঁদের অবস্থানের কারণে এলাকাবাসী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এ এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের যেমন দরকার, তেমনি পুলিশ ফাঁড়িরও দরকার।’
বেড়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, ‘একটি ক্রাইসিস মুহূর্তে আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে গিয়ে উঠতে হয়েছিল। বিকল্প জায়গা না পাওয়ায় এখনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকেই অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে আমাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে। সেখান থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হবে কি না বা বিকল্প পুলিশ ফাঁড়ির ব্যবস্থা করা হবে কি না, সে ব্যাপারটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানেন। তবে আপাতত সেখান থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের কোনো নির্দেশনা নেই।’
এদিকে পদ্মা ও যমুনার দুর্গম চরাঞ্চল নিয়ে গঠিত ঢালারচর ইউনিয়নটি উপজেলা সদর থেকে স্থানভেদে ২৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দুর্গম এলাকার কারণে উপজেলা সদরে অবস্থিত হাসপাতালে গিয়ে ইউনিয়নবাসীর চিকিৎসা নেওয়াটা দুরূহ ব্যাপার। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেই এলাকাবাসী এখানে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দাবি করে আসছিল। এ ছাড়া এলাকায় সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের তৎপরতা থাকায় ইউনিয়নবাসীর দাবি ছিল এখানে একটি স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়িও হোক।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশের গোয়ালনগর বাজারে কথা হয় পল্লী চিকিৎসক মনসুর আলীর (৩৮) সাথে। তিনি বলেন, ‘অসুখ-বিসুখে এখানকার মানুষ কতটা অসহায় তার একটি উদাহরণই যথেষ্ট। বছরখানেক আগে আকনাই গ্রামের আবু শেখের দেড় বছরের মেয়ে জ্বরে আক্রান্ত হলে আমি তাকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলি। কিন্তু দুর্গম এলাকার কারণে হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতিকালেই বাচ্চাটি মারা যায়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালু থাকলে হয়তো বাচ্চাটিকে বাঁচানো যেত। এমন ঘটনা এ এলাকায় মাঝে মাঝেই ঘটছে।’
গোয়ালনগর গ্রামের রমজান আলী (৪০) বলেন, ‘কয়েক মাস আগে আমার দুই বছরের ভাতিজা পানিতে ডুবে যাওয়ার পর তাঁকে উদ্ধার করে প্রায় ১২ কিলোমিটার দুর্গম ও বিপজ্জনক রাস্তা পাড়ি দিয়ে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পর চিকিৎসক জানান, আধা ঘণ্টা আগে আনলেও তাকে বাঁচানো যেত। এখানকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি খোলা থাকলে হয়তো আমার ভাতিজার এমন পরিণতি হতো না।’
এদিকে থানা রিস্ক রিডাকশন সোসাইটি (টিআরআরএস) নামের একটি সংগঠন পুলিশ ফাঁড়িটি অন্যত্র স্থানান্তর করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি দ্রুত চালু করার দাবি করেছে। এ দাবিতে সংগঠনটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় ও সহকারী পুলিশ সুপারের (এএসপি) কার্যালয়ে সম্প্রতি স্মারকলিপি দিয়েছে।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাত্তার খান এনটিভিকে বলেন, ‘অসহায় ঢালারচরবাসী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছে। অতি দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালু করা প্রয়োজন।’
বেড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাদের বলেন, ‘এলাকাবাসীর জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও পুলিশ ফাঁড়ি দুটোরই দরকার। বিকল্প স্থানে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি দ্রুত চালু করার উদ্যোগ নেব।’