‘আন্ধার থাকি উজাল হইল’
‘ছিট একেবারে আন্ধার (অন্ধকার) আছলো (ছিল), সেই আন্ধার থাকি আইজ উজাল (উজ্জ্বল) হয়া গেইল (গেল), মুক্তি হয়া গেইল। সেই বাদে হামরা ম্যালা খুশি।’
শনিবার পড়ন্ত বিকেলে কথাগুলো বলছিলেন ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ আলিজান বেগম। তিনি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার অভ্যন্তরে থাকা গোতামারী ছিটমহলের বাসিন্দা। এদিন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তির দলিল হস্তান্তরের খবর পাওয়ার পর এ অভিব্যক্তি জানান দীর্ঘদিন ধরে ‘নিজভূমে পরবাসী’ ওই বৃদ্ধা।
শুধুই তিনিই নন, সীমান্ত বা কাঁটাতারের বেড়া থেকে অনেক দূরে, বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলের সীমানা পিলারগুলো যেন ছয় দশকের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল এসব মানুষকে। তাই শনিবার যেন তাদের সেই অবরুদ্ধ জীবনের অবসান হয়েছে, মিলেছে মুক্তি। দলিল হস্তান্তরের খবর পাওয়ার পর থেকে ভারতীয় এসব ছিটমহলে শুরু হয়েছে উল্লাস-আনন্দ। চলছে আনন্দ-মিছিল আর মিষ্টি বিতরণ।
বিকেলে হাতীবান্ধার গোতামারী ছিটমহলে গিয়ে দেখা যায়, ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির কার্যালয়ে ব্যাটারি দিয়ে চলছে টেলিভিশন। সেখানে পিনপতন নীরবতা, সবার চোখ টিভির পর্দায়। বিকেলে যখন সেই পর্দায় ভেসে আসে স্থলসীমান্ত চুক্তি বিলের দলিল হস্তান্তরের দৃশ্য, ঠিক তখনই শুরু হয় বাঁধভাঙা উল্লাস। ছিটমহলবাসীর কেউ কেউ জড়িয়ে ধরেন একে অপরকে। শিশু-বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ মিলে যায় এককাতারে।
ঘর থেকে বের হয়ে আসেন গৃহবধূরা। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে তাৎক্ষণিকভাবে বের করা হয় আনন্দ মিছিল। সেই মিছিল ঘুরে বেড়ায় ছিটমহলের মেঠোপথ। মিছিল থেকে ‘’৭৫-এর চুক্তি-ছিটবাসীর মুক্তি’, ‘নরেন্দ্র মোদির আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘মমতা ব্যানার্জির আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘ধন্যবাদ ধন্যবাদ, শেখ হাসিনা ধন্যবাদ’ স্লোগান দেওয়া হয়।
ছিটমহলের বাসিন্দা আছর উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘শুধু আমিই নই, সকল ছিটমহলবাসীই আজ আনন্দিত। এ আনন্দের কোনো শেষ নেই। এ জন্য হাসিনা-মোদিকে আমরা ধন্যবাদ জানাই, তাঁদের জন্য দোয়া করি।’
‘আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আর ছিটমহলের বিনিময় দেখে মরতে পারব না। কিন্তু আমার ধারণা আজ ভুল প্রমাণিত করে ছিটমহল বিনিময় হলো, তাই আমি অনেক অনেক খুশি,’ আরেক বাসিন্দা সহির উদ্দিন বলছিলেন।
এ খবরে খুশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আমিনা বেগম বলে, ‘আমরা যা এতদিন পাইনি, তা এখন থেকে পাব। আমরা এতদিন অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি; কিন্তু এখন আর আমাদের সেই কষ্ট থাকবে না।’
নতুন করে স্বাধীনতা পেলাম উল্লেখ করে গৃহবধূ বানেচা বেগম বলেন, ‘আজ আমাদের মতো খুশি আর কেউ নেই।’ একইভাবে আনন্দ প্রকাশ করেন দিনমজুর অমল বর্মণ (৫০) আর দুলালী বেগম।
শুধু গোতামারী ছিটমহলই নয়, লালমনিরহাটের অভ্যন্তরে থাকা ভোটবাড়ী, বাঁশকাটা, লতামারীসহ বিভিন্ন ছিটমহলই যেন ভাসছে আনন্দের বন্যায়। ছিটমহলবাসী জানিয়েছেন, তাদের এ আনন্দ-উল্লাস থাকবে আরো কয়েক দিন।