প্রথমে আ. লীগ নেতা, এখন ইউএনও!
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার গোপালপুরে অবস্থিত দুর্গাপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ১৮ মাস আগে অবৈধভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরে ওই শিক্ষক উচ্চ আদালত ও শিক্ষা বোর্ড থেকে বহালের অনুমতি পেলেও তাঁকে বিদ্যালয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক না থাকায় গত অক্টোবর থেকে সব শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। এতে চরম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনামতো মো. খাদেমুল ইসলাম নামের ওই প্রধান শিক্ষককে বহাল না করায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনজনের নামে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। উচ্চ আদালতে আনা ওই অভিযোগে মিঠাপুকুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন-অর-রশীদ, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম এবং বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে মিলনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান মো. আবদুল হালিমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্গাপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী (নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর) পদটি ফাঁকা হওয়ায় ২০১৫ সালের ১৯ মে পত্রিকায় (দৈনিক খবরপত্র ও দৈনিক দাবানল) একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী অনেকেই আবেদন করেন। পরে আবেদনপত্র বাছাই করে ২২ জনকে পরীক্ষার জন্য নির্ধারণ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর নিয়োগ বোর্ড গঠন করতে গেলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাদেমুল ইসলাম ও ব্যবস্থাপনা কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি করেন তৎকালীন কমিটির সভাপতি আবদুল হালিম।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাদেমুল ইসলামের অভিযোগ, ব্যবস্থাপনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি আবদুল হালিম ওই পদে নিজের পছন্দের লোককে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার জন্য নিয়োগ বোর্ডে তাঁর পছন্দের লোক রাখতে চান। কিন্তু তাতে বিরোধিতা করেন বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষক ও কমিটির সদস্যরা। তাঁরা নিয়মমতো সব কিছু করার দাবি তোলেন। পরে এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে তাঁকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বরখাস্ত করেন তৎকালীন সভাপতি।
প্রধান শিক্ষকের অভিযোগ, কোনো শিক্ষককে বরখাস্ত করতে হলে ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে কয়েক দিন সময় দিয়ে একটি নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু সাবেক সভাপতি ব্যবস্থাপনা কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক না করেই তাঁকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেন। এ বিষয়ে কমিটির একাধিক সদস্য প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
তবে ব্যবস্থাপনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি আবদুল হালিমের দাবি, নিয়ম মেনেই প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। নিয়মিত বিদ্যালয়ে না আসায় তাঁকে একাধিকবার বলার পরেও না শোনার কারণে বরখাস্ত করা হয়। নিয়োগ নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলে দাবি করেন তিনি।
বিদ্যালয়ের কাগজপত্র থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর প্রধান শিক্ষক মো. খাদেমুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে ওই বছরের ১৯ নভেম্বর ওই শিক্ষকের বরখাস্ত অবৈধ বলে ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। এর আট সপ্তাহের মধ্যে তাঁকে বিদ্যালয়ে বহাল করার জন্য আদেশ দেন আদালত। কিন্তু এই আদেশের পরও ওই শিক্ষককে বিদ্যালয়ে বহাল না করায় গত বছরের ৮ মে তিনি দিনাজপুরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে একটি লিখিত আবেদন করেন।
সেখানে খাদেমুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ১৯৯৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর তাঁকে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অন্যায় ও অবৈধভাবে সাময়িক বরখাস্ত করেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই শিক্ষককে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কমিটির ৫ সদস্য পদত্যাগ করার আবেদন করেন। এরপর ওই বিষয়ের তদন্ত পরিদর্শক বিষয়টি তদন্ত করে ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতিকে এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। কিন্তু সভাপতি নোটিশের জবাব না নেওয়ায় গত বছরের ৪ জানুয়ারি ওই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।
এরপর আবার ওই সভাপতি একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করলেও গত বছরের ২২ আগস্ট দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ওই কমিটির কার্যক্রম বিধি মোতাবেক না হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করে। শিক্ষা বোর্ডের একই চিঠিতে প্রধান শিক্ষককে পুনরায় অ্যাডহক কমিটি গঠনের অনুমতি দিতে মিঠাপুকুরের ইউএনওকে অনুরোধ করা হয়।
এরপর গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড আবার মিঠাপুকুরের ইউএনওকে একটি চিঠিতে ওই শিক্ষককে পুনর্বহাল করে নতুন করে অ্যাডহক কমিটি গঠনের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে জানায়। কিন্তু তাতেও ইউএনও কোনো পদক্ষেপ নেননি। পুনর্বহালের জন্য ওই শিক্ষক ইউএনওর কাছে লিখিত আবেদন করলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। তাই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাধ্য হয়ে আবার গত ২৮ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে তিনজনের নামে আদালত অবমাননার অভিযোন আনেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ইউএনওকে একজন অভিভাবক সদস্য মনোনীত করে প্রধান শিক্ষককে অ্যাডহক কমিটি গঠনের অনুমতি দেবেন। কিন্তু ছয় মাস আগে কাজে যোগ দেওয়ার পরও ইউএনও মামুন-অর-রশীদ তা করছেন না। এ কারণে প্রধান শিক্ষকের পক্ষেও অ্যাডহক কমিটি গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই তিনি বিদ্যালয়েও যেতে পারছেন না। এ ছাড়া ইউএনও ওই প্রধান শিক্ষকের পুনর্বহালের ব্যাপারে আইনগত কোনো সহায়তা করছেন না বলেও অভিযোগ শিক্ষকদের।
নিয়ম ভেঙে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক
দুর্গাপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক না থাকলে সহকারী প্রধান শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার বিধান। কিন্তু ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি তাও ভঙ্গ করেছেন। তিনি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. লোকমান হাকিমকে বিধান বহির্ভূতভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক করে রেখেছেন। বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল কালাম আজাদ এ বিষয়ে প্রতিবাদ করলে তাঁকেও বরখাস্ত করেন ওই সাবেক সভাপতি। এ বিষয়ে ইউএনও নীরব রয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতির বাড়ির সামনে স্কুলটি হওয়ায় সেখানে শিক্ষা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটিয়ে নানা রকম কার্যক্রম পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি আবদুল হালিম দাবি করেন, ‘নিয়ম মেনেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এখন যেহেতু আমি ওই স্কুলে নেই তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’
যোগাযোগ করা হলে মিঠাপুকুরের ইউএনও মামুন-অর-রশীদ দাবি করেন, ‘আমি কয়েক মাস (ছয় মাস হবে) আগে দায়িত্ব নিয়েছি। তাই সব বিষয় ঠিকমতো জানি না। আদালত যদি ওই শিক্ষককে বহাল করতে বলেন, তাহলে অবশ্যই তা পালন করা হবে।’
বিদ্যালয়ে বেতন বন্ধ ছয় মাস ধরে
ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রধান শিক্ষক না থাকায় দুর্গাপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ছয় মাস ধরে শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির ১২ জন শিক্ষক ও তিনজন কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ছাড়া বর্তমানে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমও ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রোকসানা বেগম বলেন, ‘আমি বুঝতেছি ওই বেতনের ওপর বিদ্যালয়ের সবার জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে। কিন্তু দ্রুত ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। যেহেতু ওই প্রতিষ্ঠানের সবাই নিজেরা মিলে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে তাই তাদেরকে সেই চেষ্টা করতে বলা হয়েছে।’