‘কাটা হাত নিয়ে দুর্বৃত্তরা ক্যাচ খেলেছে’
খুলনা মহানগরীর গল্লামারী মোহাম্মদনগর এলাকায় ইমরান সজীব আকনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। তাঁর বাবা নজরুল ইসলাম আকন ঘটনার দিন শুক্রবার রাতেই স্থানীয় ‘যুবলীগকর্মী’ হাফিজকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
ঘটনার সহিংসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাদী নজরুল ইসলাম আকন কান্নায় ভেঙে পড়ে আজ শনিবার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “হত্যাকারীরা সজীবের শরীর থেকে হাত কেটে নেওয়ার পর উল্লাসে সেই হাত একে অপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে ‘ক্যাচ’ খেলে। একপর্যায়ে তা খালের পানিতে ফেলে দেয়।”
গত শুক্রবার মোহাম্মদনগর এলাকার সজীবকে কুপিয়ে আহত করে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। বাড়িতে সজীবের বাবা-মা-ভাই ছাড়াও স্ত্রী ও দুই বছরের এক ছেলে রয়েছে। নজরুল ইসলাম আকন ছেলেকে যুবলীগকর্মী বলে দাবি করলেও স্থানীয় যুবলীগ নেতারা তা অস্বীকার করেছেন। পুলিশের দাবি, সজীব হত্যা মামলার আসামি। তিনি সম্প্রতি সেই মামলায় জামিনে বেরিয়ে আসেন।
লবণচরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরদার মোশাররফ হোসেন আজ এনটিভি অনলাইনকে জানান, মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আরমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মামলার অপর আসামিরা হচ্ছেন মাহাবুব, চঞ্চল, ভাগ্নে সুমন, সজল, জামাই মনির, সিরাজ, তানজির রহমান ওসান, ন্যাটা বাবু, আরমানসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫/২০ জন।
আজ শনিবার দুপুরে মোহাম্মদনগর এলাকার সজীবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল শোকের মাতম। ছেলেহারা মা শাহনাজ বেগমের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে বাড়ির পরিবেশ। সজীবের ছেলে রোহানকে কোলে নিয়ে নিথর বসে ছিলেন স্ত্রী শারমীন।
সজীবের বাবা নজরুল ইসলাম ঘটনার জন্য ‘যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য’ হাফিজকে দায়ী করে বলেন, জমি ও স্থানীয় রাজনীতির দ্বন্দ্বে সজীব খুন হয়েছে। তিনি দাবি করেন, এর আগে ১৯৯৮ সালের ৮ আগস্ট বাবুল গাজী নামের এক বিএনপিকর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করে হাফিজের লোকজন। এ ঘটনায় ৯ আগস্ট নিহতের ভাই বাদী হয়ে হাফিজসহ ১৪ সহযোগীর নাম উল্লেখ করে মামলা করেছিলেন।
২০০১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ মিস্ত্রী জাফর মোল্লাকে হত্যা করা হয়। ওই দিনই বটিয়াঘাটার থানায় হাফিজের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় হাফিজের বিরুদ্ধে অর্ধডজন মামলা আছে বলে জানান সজীবের বাবা।
সজীবের মা শাহনাজ বেগম এনটিভি অনলাইকে বলেন, ‘হাফিজ সজীবকে দলে ভেড়াতে অনেক আগে থেকে চেষ্টা করছিল। কিন্তু সজীব হাফিজকে পছন্দ করে না। এ জন্য হাফিজ বিভিন্ন মামলায় সজীবকে ফাঁসিয়েছে। দেড় মাস আগেও হাফিজের লোকজন বাড়ির গেট কুপিয়ে গেছে। সজীব সব সময় বলত, হাফিজ আমাকে মেরে ফেলতে পারে।’
‘শুক্রবার সকালে আমার স্বামীকে হাফিজ ফোন করে ডেকে নিয়ে যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সজীবকে কারা ফোন করে জানায়, সাচিবুনিয়ায় তার ঘেরে হামলা হয়েছে। সজীব দ্রুত মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে যেতেই হাফিজের লোকেরা তাকে ঘিরে ফেলে। তারা সজীবকে এমনভাবে কুপিয়েছে যে, শরীরে সেলাই করা যায়নি। কাটা হাত নিয়ে রাস্তায় উল্লাস করেছে সন্ত্রাসীরা,’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন সজীবের মা।
সজীবের বাবা নজরুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি সাচিবুনিয়ায় একটি জমি কিনে প্লট আকারে বিক্রির উদ্যোগ নেন তিনি। বৃহস্পতিবার ওই জমিতে রাস্তা নির্মাণ করতে গেলে হাফিজের লোকজন বাধা দেয়। কাজ করতে হলে হাফিজকে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানায়।
এ নিয়ে হাফিজের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলছিল। কিন্তু হাফিজ যে ছেলেকে মেরে ফেলবে, সেটা ভাবতে পারেননি নজরুল ইসলাম।
মামলার এজাহারে নজরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, সাচিবুনিয়া এলাকায় তাঁর জমিতে কাজ করতে গেলে হাফিজের লোকজন বাধা দেয়। পরে জমির কাগজপত্র নিয়ে শুক্রবার হাফিজের গল্লামারী ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে যেতে বলে। শুক্রবার বেলা ১১টায় আবারো তাঁকে ফোন করে ডেকে নিয়ে গল্লামারী ওয়েলফেয়ার অফিসে বসিয়ে রাখে।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু সময় পরই এলাকার লোকজন জানায় যে, সজীবকে কারা কুপিয়ে ফেলে রেখে গেছে। দ্রুত লবণচরা থানার ওসিকে ফোন করে ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে যেতেই দেখি মাহাবুব, চঞ্চল, ভাগ্নে সুমন, সজল, জামাই মনির, সিরাজ, ওসান ও ন্যাটা বাবু রামদা, চায়নিজ কুড়াল, চাপাতি নিয়ে উল্লাস করতে করতে যাচ্ছে।’
এজাহারে আরো উল্লেখ রয়েছে, বড় ভাই মিজান ও অন্যরা মিলে সজীবকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার সময় সজীব জানায়, মাহাবুব ও চঞ্চল চেপে ধরে এবং ভাগ্নে সুমন তার মাথার পেছনে কোপ মারে ও হাত কেটে ফেলে। সিরাজসহ অন্যরা সারা শরীরে কোপায়। মূলত হাফিজুর রহমান হাফিজ সুপরিকল্পিতভাবে তাঁকে আটকে রেখে আসামিদের দিয়ে তাঁর ছেলে সজীবকে খুন করিয়েছে।
এ ব্যাপারে হাফিজের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।