সারি সারি বোতল দিয়ে তৈরি হচ্ছে বাড়ি
ইট-পাথরের সঙ্গে সুরকি-সিমেন্ট মিশিয়ে বাড়ি তৈরির কথাই এতদিন সবাই জানত। তবে এবার লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম নওদাবাসে প্লাস্টিকের (পিইটি) বোতল আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বাড়ি। পরিবেশবান্ধব বা ইকোহাউসের ধারণা নিয়ে জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বাড়ি তৈরির বিষয়টি পুরোনো হলেও বাংলাদেশে সম্ভবত এটিই প্রথম।
খরচ অনেক কম, পরিবেশবান্ধব, ভূমিকম্প সহনীয়, বুলেট প্রুফ, শত বছরেও নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই—এমন ধারণা থেকেই এ বাড়ি তৈরির কাজে হাত দেওয়া হয়েছে বলে জানান বাড়িটির নির্মাতা রাশেদুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী আসমা খাতুন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওদাবাস গ্রামের আবদুল বারী মোক্তারের ছেলে রাশেদুল ইসলাম উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। সেখানেই একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন পুরান ঢাকার নিমতলীর মেয়ে আসমা খাতুন। পরে তাঁরা দুজনে বিয়ে করে প্রায় আট বছর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন।
বিয়ের পর তাঁদের দুটি সন্তান হয়। এক সন্তানের কথা বলায় সমস্যা ছিল। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, খোলামেলা পরিবেশে ও শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে দিলে সে হয়তো কথা বলতে পারবে। পাশাপাশি ওই দম্পতিরও একটা টান ছিল খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি।
ফলে কিছুদিন আগে রাশেদুল পরিবার নিয়ে ঢাকা ছাড়েন। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে যান কালীগঞ্জের সীমান্তবর্তী নওদাবাস গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে। এর পর থেকেই ভাবছিলেন একটা বাড়ি তৈরির বিষয়ে। তবে মোটামুটি একটা বাড়ি করার মতো টাকা ছিল না তাঁদের। শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেট ঘেঁটে তাঁরা খোঁজ পান বোতলবাড়ির। আর সেটাই তৈরির সিদ্ধান্ত নেন শেষ পর্যন্ত।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৪০ শতাংশ জমির ওপর তৈরি হচ্ছে আলোচিত সেই বোতলবাড়ি। রয়েছে চার রুমের থাকার ঘর, দুটি বাথরুম, রান্নাঘরসহ বারান্দা। সেপটিক ট্যাংক ও মেঝেতেও ব্যবহার করা হয়েছে বোতল। এক লিটার এবং আধা লিটার বোতলে বালু ঢুকিয়ে সিমেন্ট দিয়ে ইটের বদলে গাঁথা হয়েছে। দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে আধা লিটার পানীয় ধারণক্ষমতার প্লাস্টিকের বোতল।
বাড়ির নির্মাতা রাশেদুল ইসলাম জানান, তাঁর বড় ছেলে মানসিকভাবে অসুস্থ। কথা বলতে তার সমস্যা হয়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেলেকে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতেই গ্রামে ফিরে আসা। আর এখানে এসে প্রয়োজন হয় একটি বাড়ির। কিন্তু হাতে যথেষ্ট টাকা-পয়সা ছিল না। একসময় ইন্টারনেটের বদৌলতে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে ‘ইকোহাউস’ নামে বাড়ি তৈরির খোঁজ মেলে। এতে উৎসাহিত হন তাঁর স্ত্রী আসমাও। শেষপর্যন্ত ওই বাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।
প্রথমে বিষয়টি পরিবার ও প্রতিবেশীরা পাগলামি হিসেবেই হাসাহাসি করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত এটা তাদের একটা গর্বের বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে বলে জানান রাশেদুল।
বোতল দিয়ে বাড়ি তৈরি হবে, এমন কথা প্রথমে মানতে নারাজ ছিলেন রাশেদুলের বড় ভাই শফিউর রহমান। কিন্তু এখন তিনি গর্ব করে বলেন, “আমার ভাই ও তাঁর স্ত্রী পরিবেশবান্ধব বাড়ি তৈরির মাধ্যমে একদিন দেশে ‘বোতলবাড়ির’ উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।”
রাশেদুলের স্ত্রী আসমা খাতুন জানান, বোতল-বালি ইটের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি শক্ত। বালু গরমে তাপ শোষণ করে ঘরকে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা রাখে। গরমের দিনে অন্যান্য ঘরের তুলনায় এটা শীতল থাকে। পরিবেশবান্ধব, তাপশোষক, অগ্নিনিরোধক ও ভূমিকম্প সহনীয় এ বাড়ি তৈরিতে ইটের বাড়ি অপেক্ষা ৪০ শতাংশ কম টাকা খরচ হবে।
ওই দম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়িটি নির্মাণে ব্যবহার হবে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার প্লাস্টিকের বোতল। ওজনে যা প্রায় ৪০ মণ। এখন পর্যন্ত তাঁরা কিনেছেন তিনটি ভিন্ন আকারের ৬০ মণ কোমলপানীয় ও বিভিন্ন পানীয়ের খালি বোতল। প্রতি কেজি বোতল প্রকারভেদে কিনতে হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। মাটির নিচ থেকে শুরু করে মেঝে, দেয়াল, সেপটিক ট্যাংকে বোতল ব্যবহার হলেও ওপরে ছাদের বদলে করা হবে টিন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া নির্মাণকাজ মাসখানেকের মধ্যে শেষ হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
এদিকে প্রতিদিনই কালীগঞ্জের নওদাবাস গ্রামে বহিরাগতদের ভিড় দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছেন এসব মানুষ। বাড়ির নির্মাণ শ্রমিকরা প্রথমে বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত না থাকলেও এখন তাঁরাও বেশ আনন্দে চালিয়ে যাচ্ছেন কাজ।
পাশের উপজেলা হাতীবান্ধা থেকে বোতলবাড়ি দেখতে আসা মকছুদার রহমান বলেন, লোকমুখে শুনে বাড়িটি দেখতে এসেছেন তিনি। ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়েও অনেক বড় কাজ করা যায় দেখে খুশি তিনি।
নির্মাণশ্রমিক রুদ্রেশ রায় বলেন, কোনোদিন ইটের পরিবর্তে বোতল ব্যবহারের কথা শোনেননি তিনি। কিন্তু এখানে এ কাজ করে বেশ মজা পাচ্ছেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কালীগঞ্জ উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী পারভেজ নেওয়াজ খান বলেন, এ ধরনের বাড়ি এর আগে নির্মাণের কোনো তথ্য নেই। কম খরচে পরিবেশবান্ধব এ ধরনের বাড়ি তৈরি করতে পারলে প্রান্তিক মানুষের উপকার হবে। তবে সে জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে।