স্ত্রী ঘরে রেখে নির্যাতন, ভুয়া চিকিৎসক গ্রেপ্তার!
বরগুনায় স্ত্রী নির্যাতনের অভিযোগে মাসুম বিল্লাহ নামের এক ভুয়া চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
দীর্ঘদিন ধরে ধরে মাসুম বিল্লাহ নিজেকে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বলে পরিচয় দিয়ে বরগুনা শহরে প্রতারণার মাধ্যমে চিকিৎসা বাণিজ্য চালিয়ে আসছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এক বছর ধরে বরগুনা শহরের একটি ভাড়া বাসায় বন্দি রেখে গোপনে নিজের স্ত্রীকে নির্মম নির্যাতন করে আসছিলেন মাসুম। রোববার বিকেলে বাড়ির মালিকপক্ষের তথ্যের ভিত্তিতে বরগুনার বাজার সড়কের পাঁচতলা ভবন ‘গোলাপ প্লাজা’র একটি ফ্ল্যাট থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
নির্যাতনের শিকার স্ত্রী কানিজ ফাতিমা সোনিয়া (২৪) জানান, দীর্ঘ এক বছর ধরে তাঁকে একটি ফ্ল্যাটে তালাবদ্ধ রেখে নির্মম নির্যাতন করে আসছিলেন মাসুম বিল্লাহ। নিজেকে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে আজ থেকে ১৪ মাস আগে তাঁকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন, শিশু বিশেষজ্ঞ তো দূরের কথা মাসুম বিল্লাহ কোনো চিকিৎসকই নন। কিছুদিন আগেও বরগুনার একজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মো. আলমগীর হোসেনের চেম্বারে ফুট ফরমায়েসের কাজ করতেন তিনি।
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কানিজ ফাতিমা সোনিয়া বলেন, এর আগে তিনি বিয়ে করিছিলেন। তাঁর একটি শিশুপুত্র রয়েছে। তাঁর স্বামী বিদেশ থাকতেন। বছর দেড়েক আগে তাঁর সঙ্গে মাসুম বিল্লাহর পরিচয় হয়। সেই থেকে নিজেকে একজন বড় মাপের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে মুঠো ফোনে তাকে বিভিন্ন সময়ে প্রেমের প্রস্তাব দিতে থাকেন মাসুম বিল্লাহ। একপর্যায়ে ২০১৬ সালের ৫ মার্চ তাঁকে বিয়ে করেন মাসুম বিল্লাহ। বিয়ের পর থেকেই মাসুম বিল্লাহ তাঁকে যৌতুকের জন্য শারীরিকভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন করতে থাকেন। ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কানিজ ফাতিমা সোনিয়াকে তালাক দেন মাসুম বিল্লাহ।
কানিজ ফাতিমা সোনিয়া আরো জানান, তাকে তালাক দেওয়ার পর পরই সব কিছু গোপন রেখে মাসুম বিল্লাহ বরগুনার পাতাকাটা এলাকায় তাঁর মামাত বোনকে বিয়ে করেন। কিছুদিন পর সেই মামাত বোনকেও তালাক দেন তিনি। এ সময় কানিজ ফাতিমা সোনিয়া পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় তাঁর খালুর বাড়ি অবস্থান করতেন। এরপর আবারও সেই বাড়ি গিয়ে খালা-খালুর হাতে পায়ে ধরে কানিজ ফাতিমা সোনিয়াকে বরগুনায় নিয়ে আসেন। এরপর আবারও বাসায় কাজি ডেকে দ্বিতীয়বারের মতো তাঁকে বিয়ে করেন মাসুম।
সোনিয়া আরো জানান, বিয়ের পর একপর্যায়ে তিনি সন্তান সম্ভবা হলে তাঁকে জোর করে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে গর্ভপাত করান মাসুম। এ ঘটনার পর তিনি অনেক দিন অসুস্থ ছিলেন।
বরগুনা শহরের বাজার সড়কে গোলাপ প্লাজার মালিক আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী সামসুন্নাহার জানান, বছরখানেক ধরে তাদের ভবনের পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাটে কানিজ ফাতিমা সোনিয়াকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন মাসুম বিল্লাহ। প্রায় প্রতিদিনই মাসুম বিল্লাহ তাঁর স্ত্রী সোনিয়াকে শারীরিক নির্যাতন করে তালাবদ্ধ করে রেখে যেতেন। রোববার বিকেলে পুনরায় স্ত্রী সোনিয়াকে নির্যাতন শুরু করলে তিনি পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে মাসুম বিল্লাহকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান।
মাসুম বিল্লাহর গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের খাকবুনিয়া গ্রামে। এখানকার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ মো. জালাল আহমেদ জানান, খাকবুনিয়া গ্রামের মাসুম বিল্লাহর ভুল চিকিৎসার কারণে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে স্থানীয় অধিবাসী শাহিন খানের স্ত্রী ফরিদা বেগমের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মাসুম বিল্লাহর বিরুদ্ধে সে সময় বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলাও করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
এদিকে, গ্রাম ডাক্তার সমিতির সভাপতি গ্রাম ডাক্তার এম এ মোতালেব জানান, মাসুম বিল্লাহ নিজেকে ডিএমএফ এবং ডিএমসিএইচ পাস একজন চিকিৎসক বলে পরিচয় দিয়ে বরগুনা শহরে ডাক্তারি করে আসছিলেন। অথচ তাঁরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, তিনি কোনো বিষয়েই ডাক্তারি পড়াশোনা করেননি। কোনো সার্টিফিকেট যদি মাসুম বিল্লাহ জোগাড় করেও থাকেন তা বানোয়াট ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, বছর কয়েক আগেও বরগুনার শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আলমগীর হোসেনের চেম্বারের একজন পিওন ছিলেন মাসুম বিল্লাহ।
বরগুনার গ্রাম ডাক্তার সমিতির সাধারণ সম্পাদক গ্রাম ডাক্তার আনোয়ার হোসেন শিমুল জানান, ভুল চিকিৎসায় এক দরিদ্র নারীর মৃত্যুর অভিযোগে মাসুম বিল্লাহর বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলা রয়েছে। তিনি আরো জানান, এর আগে মাসুম বিল্লাহ তাঁর চেম্বারে কর্মরত একজন নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। পরে টাকা-পয়সা দিয়ে সে ঘটনাকে ধামাচাপা দেন মাসুম বিল্লাহ।
তবে গ্রেপ্তারের আগে মাসুম বিল্লাহ জানান, এটি তাঁর পারিবারিক বিষয়। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে পরে ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারি সার্টিফিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুলনা থেকে তিনি চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্স ‘ডিএমএফ’ করেছেন। তবে আপনার সাইনবোর্ডে ডিএমএফ-ঢাকা লেখা কেন এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এ বিষয়ে বরগুনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদুজ্জামান বলেন, নির্যাতনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে নির্যাতিত স্ত্রীকে উদ্ধারের পর মাসুম বিল্লাহকে গ্রেপ্তার করে বরগুনা থানার পুলিশ। এ বিষয়ে গৃহবধূ কানিজ ফাতিমা সোনিয়া বাদী হয়ে বরগুনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেছেন। এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. জসিম উদ্দিন হাওলাদান বলেন, আজকেই বিষয়টি তিনি জেনেছেন। পুলিশ তাঁর কাছে জানতে চাইলে সহযোগিতা করবেন।