শত নারীর জীবন বদলে দিয়েছেন যে এসপি
ভরদুপুর। বরগুনা শহরের সার্কিট হাউসসংলগ্ন নির্জন মাঠে একাকী একটি মেয়ে। হাতে বিষের বোতল। কয়েকজন খেয়াল করে বুঝলেন হয়তো আত্মহত্যার প্রস্তুতি। খবর চলে যায় জেলা পুলিশের কাছে। কয়েকজন নারী পুলিশের সহযোগিতায় ঘটনাস্থল থেকে বিষের বোতলসহ মেয়েটিকে আনা হয় বরগুনা জেলা পুলিশের ‘জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্রে’।
মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁর বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায়। দাম্পত্য কলহের জের ধরে তাঁর বাবা-মায়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন সংসার করছেন।
মেয়েটি মেধাবী শিক্ষার্থী। বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞান (অ্যাকাউন্টিং) বিভাগে অনার্সে ফার্স্টক্লাস পেয়েছেন মেয়েটি। মাস্টার্স পড়ছেন তিনি। তাঁর ছোট বোনও দশম শ্রেণির মেধাবী শিক্ষার্থী। এ বাড়ি ও বাড়ি টিউশনি করে কোনোমতে চলে দুই বোনের পড়াশোনা।
কিন্তু এর মধ্যেই এর ওর উত্ত্যক্ত করা। কথা শোনার বিষয়টি তো আছেই। একে তো নারী, তার ওপর পায়ে পায়ে তাঁর নারী হওয়ার যন্ত্রণা। এমন পরিস্থিতিতে বিষপানে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন তরুণীটি।
হতাশাগ্রস্ত সেই মেয়েটির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে তাঁর দুঃখ ভুলিয়ে দেয় জেলা পুলিশের জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্রের একটি দল। বরগুনার পুলিশ সুপার নিজেও কথা বলেন মেয়েটির সঙ্গে। যে কোনো সমস্যায় মেয়েটির পাশে থাকার আশ্বাস দেন তিনি।
একপর্যায়ে মেয়েটি বুঝতে পারেন তাঁর ভুল। বুঝতে পারেন আত্মহত্যার মধ্যে কোন সার্থকতা নেই। বুঝতে পারেন- জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে টিকে থাকার নামই জীবন। আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন তিনি।
ঠিক এভাবেই মমতার বাঁধনে জড়িয়ে দরিদ্র, বঞ্চিত, অসহায় এবং নির্যাতিত নারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিয়ে অনন্য এক উদাহরণ তৈরি করেছে বরগুনা জেলা পুলিশের জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাত্র আট মাসের ব্যবধানে এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নির্যাতনের শৃঙ্খল ছিঁড়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছেন বরগুনার বিভিন্ন গ্রামের তিন শতাধিক দরিদ্র অসহায় নারী।
জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্র এখন বরগুনার অসহায়, দুস্থ ও নির্যাতিত নারীদের আস্থার প্রতীক। একটি অনুকরণীয় সাফল্য। আর এ সবই হয়েছে বরগুনার কৃতী পুলিশ সুপার বিজয় বসাকের উদ্যোগে।
জেলা পুলিশের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের যে কোনো জেলার চেয়ে উপকূলীয় জেলা বরগুনায় নারী নির্যাতনের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। নানা কারণে এ জেলায় নারী নির্যাতন মামলার সংখ্যাও অন্য যে কোনো জেলার চেয়ে অনেক বেশি।
অনেক ক্ষেত্রেই দাম্পত্য জীবন এবং পারিবারিক কলহের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে এখানে নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটে থাকে। সেসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভেঙে যায় সংসার। মামলা হয় নারী নির্যাতনের। মাসের পর মাস ধরে চলে মামলা।
নারী অধিকার নিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে বরগুনায় কর্মরত একটি উন্নয়ন সংগঠনের প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা হাসি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অজ্ঞতা, অসেচতনতা এবং দারিদ্র্যের কারণে ভুক্তভোগী অসহায় নারীরা সঠিকভাবে আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন না। পারেন না নিজেদের নির্যাতন বা ভোগান্তির কথা খুলে বলতেও। ফলে একদিকে বিচারকাজ যেমন প্রলম্বিত হয়, তেমনি ভোগান্তি বাড়ে নারীদের।
আর একবার নারীরা যখন তাঁদের স্বামী বা শ্বশুরকূলের বিরুদ্ধে আদালতের আশ্রয় নেন, তখন আর ওই স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির স্বজনরা ওই নারীকে সাধারণত মেনে নিতে চান না। ফলে রুদ্ধ হয়ে আসে সমঝোতার পথও।
এসব বিবেচনায়, অসহায় দরিদ্র নারীদের পাশে থেকে আইনি পরামর্শের পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে নারী নির্যাতনের হার কমিয়ে আনতে বরগুনা জেলা পুলিশের উদ্যোগে স্থাপন করা হয় জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্র।
জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্রের একজন সুবিধাভোগী বরগুনা সদর উপজেলার দক্ষিণ মনসাতলী গ্রামের দরিদ্র গৃহবধূ মৌসুমী (ছদ্ম নাম) বলেন, নেশাগ্রস্ত স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি ছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী। একসময় মৌসুমীর এক স্বজনের মাধ্যমে অভিযোগ পেয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই ডেকে পাঠায় জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্র।
দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে ভুক্তভোগী দম্পতির ঘনিষ্ঠ হয়ে যান জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্রের সমন্বয়কারী জেলা পুলিশের নারী উপপরিদর্শক জান্নাতুল ফেরদৌস। পরে জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্রের শাসন-বারণ আর পরামর্শের ভিত্তিতে একসময় নিজের ভুল বুঝতে পারেন তাঁর স্বামী। মৌসুমী বলেন, বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের অধীনে এ সহায়তা কেন্দ্রের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী উপপরিদর্শক (এসআই)। রয়েছে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি অভিযোগ গ্রহণ কমিটি। এ ছাড়া সার্বিক সহযোগিতার জন্যে স্থানীয় সমাজসেবক, উন্নয়নকর্মী, আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও নারীনেত্রীসহ ২৫ সদস্যের একটি স্বেচ্ছাসেবক দলও রয়েছে জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্রের সঙ্গে।
২০১৬ সালের ১২ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা পুলিশের এ জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. হাছানুজ্জামান এবং নারী ও মিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের বিচারক মো. জুলফিকার আলী খান। অনুষ্ঠানে অংশ নেন স্থানীয় আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী, নারীনেত্রী এবং কমিউনিটি পুলিশিং-এর নেত্রীবৃন্দসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের শতাধিক ব্যক্তি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. হাছানুজ্জামান বলেন, ‘যে কোনো বিবাদ প্রাথমিকভাবে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হলে তার ক্ষতির পরিমাণও কম হয়। আদালতেও বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। উদ্যোগটি সঠিকভাবে পরিচালিত হলে নারী নির্যাতনের হার কমে আসবে। কমবে মামলার জটও।’
বরগুনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক চিত্তরঞ্জন শীল বলেন, ‘প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিষেধক শ্রেয়। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশেষ করে মামলা চালু হয়ে যাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলনের সম্ভাবনাটা অনেকাংশেই হ্রাস পায়। আর সংসার ভেঙে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তান-সন্ততিসহ পরিবারের সবাই। তাই যে কোনো বিবাদ বড় আকার ধারণ করার আগে শুরুতেই তা থামিয়ে দেওয়া গেলে ক্ষতির পরিমাণও কম হয়।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বরগুনা জেলা শাখার সভাপতি নাজমা বেগম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে ব্যতিক্রমী এ নারী সহায়তা কেন্দ্র নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের পাশাপাশি নারীর নিরাপত্তায় নতুন এক মাত্রার যোগ করেছে। তিনি বলেন, বরগুনা জেলা পুলিশের মতো সারা দেশের জেলা পুলিশ এমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এতে হ্রাস পাবে নারী নির্যাতন। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
জেলা পুলিশের জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্রের সমন্বয়কারী এসআই জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘প্রথম দিকে তিনি একাই জাগরণীর সকল কাজ সমন্বয় করতেন। অধিকাংশ অভিযোগের কার্যকরী সমাধানের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় এখন এত বেশি অভিযোগ জমা পড়ছে যে তা সামলাতে এখন অতিরিক্ত আরো দুজন সহকারী উপপরিদর্শক এবং একজন কনস্টেবল নিযুক্ত করা হয়েছে।’
এসআই জান্নাত আরো জানান, ‘২০১৬ সালের ১২ নভেম্বর থেকে আজ অবধি মাত্র আট মাসের মধ্যে জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্রের মাধ্যমে তারা ২১৩টি পারিবারিক নির্যাতন, আটটি যৌতুক, ১৯টি ইভটিজিং, ১৬টি বাল্যবিবাহসহ প্রায় তিন শতাধিক অভিযোগের কার্যকরী সমাধান করেছেন। পাশাপাশি সাতটি অভিযোগকে নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করা হয়েছে, নয়টি অভিযোগ লিগ্যাল এইডে পাঠানো হয়েছে এবং এখনও ২১টি অভিযোগ প্রক্রিয়াধিন রয়েছে।
পুলিশ সুপার বিজয় বসাক জানান, সবার আগে সমাজের অসহায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশার মুখোমুখি হতে হয় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকেই। তাই মামলা পরিচালনার সামর্থ্য নেই অথবা মামলায় আগ্রহী নন এমন দরিদ্র, অসহায় ও নির্যাতিত নারীদের ভোগান্তি লাঘবে পুলিশিং সেবার মধ্য দিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে জেলা পুলিশের উদ্যোগে এ সহায়তা কেন্দ্র গঠন করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর অসহিষ্ণু আচরণ এবং ছোটখাটো দাম্পত্য সমস্যা, পারিবারিক, সামাজিক, শারীরিক ও মানবিক সমস্যা, ইভটিজিং ও বখাটেদের উৎপাত, স্ত্রী-সন্তান কিংবা বৃদ্ধা বাবা-মায়ের খোঁজখবর না রাখা, খোরপোষ না দেওয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করছে জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্র।
পুলিশ সুপার বিজয় বসাক বলেন, ‘যেসব ঘটনা আপসযোগ্য শুধু সেসব বিষয় নিয়েই কাজ করছে জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্র। আপসযোগ্য নয় এমন কোনো ঘটনার ভুক্তভোগীদের নিয়মিত মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সব রকমের সহযোগিতা ও আইনি পরামর্শ দিয়ে আসছে জাগরণী নারী সহায়তা কেন্দ্র।’
২০১৫ সালের ১৪ জুন পুলিশ সুপার হিসেবে বরগুনায় যোগদান করেন বিজয় বসাক। যোগদানের পর থেকে কমিউনিটি পুলিশিং-এর উদ্যোগে নানামুখী সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুলিশি সেবাকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলেন তিনি। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীও মূল্যায়ন করেছেন বিজয় বসাকের সৃজনশীলতাকে।
পেশাগত দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) এবং ২০১২ সালে তিনি অর্জন করেন আইজি ব্যাচ। এ ছাড়া বরগুনায় যোগদানের পর থেকে এ অবধি একাধিকবার বরিশাল বিভাগের শ্রেষ্ঠ পুলিশ সুপার হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।