বিচারকের বিচার দাবিতে রাস্তায় নামল মানুষ
মেহেরপুর শহরের এক ব্যবসায়ী ফুল দিতে দেরি করায় তাঁকে পুলিশ দিয়ে তুলে জেলা জজ আদালতে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ছানাউল্ল্যাহর বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় বিচারকের বিচার ও মেহেরপুর থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ।
আজ বুধবার সকালে মেহেরপুর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে জেলা যৌথ ব্যবসায়ী সমিতি।
নির্যাতনের শিকার ওই ব্যবসায়ীর নাম টুটুল হোসেন (২৫)। তিনি মেহেরপুর শহরের বড়বাজার এলাকার ফুল সেন্টারের মালিক।
আহত টুটুল হোসেন জানান, গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে জেলা জজ আদালতের একজন পিয়ন শহরের বড়বাজার এলাকার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে তাঁর দোকানে আসেন। তিনি জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ছানাউল্ল্যাহর বিবাহবার্ষিকীর জন্য ফুল কিনতে চান এবং কাগজে শুভেচ্ছামূলক কথা লিখে দিতে বলেন। কিন্তু তাঁর হাতে বেশ কিছু কাজ থাকায় তিনি কিছুক্ষণ পরে কাজ করে দিতে চান ওই পিয়নকে। এরপর বিভিন্ন কথা বলে ওই পিয়ন সেখান থেকে চলে যান।
টুটুল আরো জানান, পিয়ন চলে যাওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা পর একটি পুলিশের গাড়ি গিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁকে জেলা জজ আদালতে বিচারক ছানাউল্ল্যাহর খাস কামরায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পুলিশের লাঠি ও নিজের পায়ের জুতা দিয়ে তাঁকে মেরে জখম করেন ছানাউল্ল্যাহ। পরে খবর পেয়ে অন্য ব্যবসায়ীরা তাঁকে উদ্ধার করে মেহেরপুর জেনালের হাসপাতালের তিন নম্বর ওয়ার্ডের কেবিনে ভর্তি করেন।
মারধরের ঘটনার পর মুখ্য বিচারিক হাকিমের কাছে ছানাউল্ল্যার বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দেন নির্যাতনের শিকার টুটুলের মামা রাশেদুল ইসলাম। সেই অভিযোগের অনুলিপি প্রধান বিচারপতি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও মেহেরপুর প্রেসক্লাবে পাঠানো হয়।
জানতে চাইলে রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘ছানাউল্ল্যাহ ম্যাজিস্ট্রেট ওনার পিয়নকে পাঠান একটা বিয়ের ব্যানার (কার্ড) লেখার জন্য, মানে ককশিটের ওপরে। আমার ভাগিনা (টুটুল) বলে যে, ‘আমার হাতে কাজ আছে, ঘণ্টা দুয়েক দেরি হবে।’ তখন ওই পিয়নটা বলে, ‘ঘণ্টা দুয়েক দেরি নয়, ম্যাজিস্ট্রেটের (কাজ) নিয়ে আসছি, এখনি দিতে হবে।’ তখন ভাগিনা বলে, “ম্যাজিস্ট্রেট হোক যেই হোক, আমার হাতের কাজটা শেষ হলে দিয়ে দেব।’ তারপর ওই পিয়নটা চলে যায়। সে (টুটুল) কিছু বুঝতে পারেনি। আধা ঘণ্টা পর পুলিশের পিকআপ এসে ওকে (টুটুল) তুলে নিয়ে জজ কোর্টের তিনতলায় সেলে নিয়ে যায়। নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই টর্চার করেন, কীভাবে টর্চার করেছেন দেখেন।’
এই বলে টুটুলের শরীরে থাকা নির্যাতনের একাধিক চিহ্ন দেখান রাশেদুল।
বিচারক ছানাউল্ল্যাহকে তাড়া
ব্যবসায়ী টুটুল হোসেনকে মারধরের ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে শহরের ব্যবসায়ী নেতারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এই খবর পেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ছানাউল্ল্যাহ পুলিশ পাহারায় মেহেরপুর জেনালের হাসপাতালে টুটুলকে দেখতে যান। এ সময় হাপাতালে অবস্থান করা মেহেরপুর হোটেল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফুল এনাম বকুল ক্ষুব্ধ হয়ে ওই বিচারককে তাড়া দেন। পরে পুলিশ পাহারায় ওই বিচারক গাড়ি নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন।
বিচারকের বিচার ও প্রত্যাহার দাবি
ব্যবসায়ী টুটুল হোসেনকে মারধরের ঘটনায় বিচারক ছানাউল্ল্যাহর বিচার ও মেহেরপুর থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে আজ সকালে মেহেরপুর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। টুটুলকে নির্যাতনের প্রতিবাদে আজ সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত শহরের সব দোকানও বন্ধ রাখে ব্যবসায়ীরা।
মেহেরপুর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান দিপুর সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন মেহেরপুর হোটেল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফুল এনাম বকুল, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ব্যবসায়ী রশিদ হাসান খান আলো, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম খোকন, যুগ্ম সম্পাদক মফিজুর রহমান ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শাহিনুর রহমান। মানববন্ধনে মেহেরপুর শহরের পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ অংশ নেয়।
মানববন্ধনে মেহেরপুর ব্যবসায়ীর সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান দিপু আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচারক ছানাউল্ল্যাহকে প্রত্যাহারসহ বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবি না মানা হলে আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
ব্যবসায়ীর সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘মান-ইজ্জত নিজের কাছে। আপনি একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা কী করে ঘটাতে পারলেন?’
ছানাউল্ল্যাহর বিরুদ্ধে নির্যাতন-লাঞ্ছনার বহু অভিযোগ
জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ছানাউল্ল্যাহর বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তিকে বিভিন্ন সময় নির্যাতন ও লাঞ্ছনা করার অভিযোগ উঠেছে। আজ ব্যবসায়ীদের মানববন্ধনে নির্যাতনের শিকার একাধিক ব্যক্তি সেসব ঘটনা তুলে ধরেন। মানববন্ধনে বক্তব্য দেন লাঞ্ছনার শিকার সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন, নির্যাতনের শিকার হোটেল ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ও সেলুন দোকানদার রুবেল হোসেন।
হোটেল ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, বিচারক ছানাউল্ল্যাহ তাঁদের হোটেলে এসেছিলেন। সামান্য বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হওয়ায় বিচারক তাঁর শরীরে গরম পানি ঢেলে দেন। এতে তাঁর শরীর পুড়ে যায়। সেই চিহ্ন এখনো রয়েছে শরীরে। ওই সময় তাঁকে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন জানান, বিচারক ছানাউল্ল্যাহ তাঁকে সোনালী ব্যাংকের দুই লাখ টাকার একটা চেক দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই চেকে বিচারকের স্বাক্ষর মেলেনি। তিনি সেই কথা বলায় তাঁকে পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে যান ছানাউল্ল্যাহ। এরপর ব্যাংকের ম্যানেজার ও তাঁকে লাঞ্ছনা করা হয়।
পুলিশের বক্তব্য
ব্যবসায়ী টুটুল হোসেনকে মারধরের বিষয়ে মেহেরপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ফুল ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঝামেলা বিষয়ে আমার কাছে কিছু পুলিশ চান তিনি (বিচারক ছানাউল্ল্যাহ)। তিনি ওই ফুল ব্যবসায়ীকে (টুটুল) উঠিয়ে আনার কথা বলেন। তখন থানায় দায়িত্বে ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম। আমি তাঁকে পুলিশ ভ্যান নিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দেই। ওখান থেকে উঠিয়ে ওই ফুল ব্যবসায়ীকে তাঁর (বিচারকের) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।’
এ বিষয়ে এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘স্যারের (বিচারক ছানাউল্ল্যাহ) নির্দেশে আমি তাঁকে (টুটুল) সেখানে (জেলা জল আদালতে) উঠিয়ে নিয়ে যাই। পরে তাঁর (বিচারক) খাস কামরাতে নিয়ে যাওয়া হয় ওই ব্যবসায়ীকে। এর বেশি কিছু আমি জানি না।’