ক্যামেরার চোখে যা দেখলাম
আগস্ট মাস শেষ হওয়ার পথে। গণমাধ্যমে সংবাদ হচ্ছে, ছবিও আসছে। রোহিঙ্গারা আবার আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে আসছে। আবার মিয়ানমারের সেনাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে ঘরছাড়া হচ্ছে এসব মানুষ।
ঢাকায় কর্মরত ফটোসাংবাদিকদের অনেকেই চলে গেছেন টেকনাফ আর উখিয়ায়। তাঁরা ছবি পাঠাচ্ছেন। অস্থিরতা আমাকেও ছুঁয়ে যায়।
বিষয়টি নিয়ে বার্তা সম্পাদক রফিকুল রঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করি। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনিও চিন্তা করছেন। গত ৮ আগস্ট এনটিভি অনলাইনের প্রধান ফকরউদ্দীন জুয়েল ভাই আমাকে ডেকে বলেন, ‘তৈরি হন। আপনাকে টেকনাফ যেতে হবে। সপ্তাহখানেক থাকতে হবে।’
মুহূর্তে যেন সতেজ হয়ে গেল শরীর। এমন একটি পরিস্থিতি; তখন ঢাকায় থাকতে কিছুতেই মন চাইছিল না।
৯ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে টেকনাফের দিকে যাত্রা শুরু করি। সঙ্গে এনটিভি অনলাইনে বাংলা বিভাগের আহমেদ আল আমীন ভাই এবং ইংরেজি বিভাগের শেখ খলিলুর রহমান সোহেল ভাই। গাড়ি চালান শামীম। সম্ভবত এ দলের সবচেয়ে কম বয়স্ক মানুষ।
মেরিন ড্রাইভে ক্ষুধার্ত অসহায় রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ সারি। ত্রাণের গাড়ি আসার অপেক্ষায় এভাবেই বসে থাকে তারা।
সকালে পৌঁছে যাই কক্সবাজার। দুপুর নাগাদ বের হয়ে যাই। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে যাত্রা শুরু করি। ইনানি বিচ পার হয়েই দেখি শত শত নারী, শিশু। তবে পুরুষ মানুষের সংখ্যা কম। পলিথিনের নিচে, খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে ওরা। আমি ছবি তুলতে থাকি। শিশুদের। আমাদের দেখেই খাবার চাইতে এলো। বোঝাই যাচ্ছে অনেক ক্ষুধার্ত। ছবি তুলছি আর ওদের কথা শুনছি। জানলাম, ১০ থেকে ১৫ দিন পাহাড়ি বনে কাটিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এরা এখানে এসেছে। শিশুদের অধিকাংশের গায়ে কোনো কাপড় নেই।
শিশুরা মেরিন ড্রাইভের এ সড়কে দৌড়াদৌড়ি করছে। গাড়ির জন্য। কোনো গাড়ি থামলেই খাবার চাইছে। কোনো কোনো গাড়ি থেকে খাবার ছুড়ে মারা হয়। ওই খাবার ধরার জন্য শিশুদের দৌড়াদৌড়ি।
এক মা তাঁর পাঁচ মাস বয়সী শিশুকে পলিথিনের ডেরায় রেখে এসেছেন। শিশুটি একাই সেখানে ঘুমিয়ে আছে। মা দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তায়। দৃশ্যটা দেখে শরীর ও মন ভেঙে পড়ল, ক্যামেরা চালাতে পারছিলাম না।
মেরিন ড্রাইভে রাস্তার পাশে পলিথিনের ওপর এভাবেই শিশুসন্তানকে রেখে খাবার সংগ্রহে গেছেন মা।
পরে একটা গাড়ি থেকে খাবার দিচ্ছে দেখে ভাঙা মনটা এটু ভালো হলো। মানুষগুলো কিছু হলেও খাবার পাচ্ছে।
গাড়িতে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কারা? জানালেন, ‘আমরা পর্যটক। আমরা এখানে ঘুরতে আসছি, ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য টাকা সংগ্রহ করে খাবার এনেছি।’ শুনে ভালো লাগল। অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানালাম।
মেরিন ড্রাইভের শাপলাপুর এলাকায় রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে কিছু সংগঠন। সেই খাবারের প্যাকেট পেয়ে তা থেকে চোখ যেন সরছেই না শিশুটির।
হোটেলে ফিরে প্রথম কাজ দ্রুত অফিসের জন্য ছবি পাঠানো। ল্যাপটপে ছবি সাইজ করে দ্রুত পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম। কিছু ছবি প্রতিবেদনের জন্য। কিছু ছবি গ্যালারির জন্য।
আমার ছবি পাঠানো শেষ। সোহেল ভাই বলেন, আপনি একটু বিশ্রাম নিন, আমার কাজ শেষ হলে আপনাকে ডাকব।
বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়েই পড়লাম। রাতে ল্যাপটপের খটখট শব্দ। যা সারা দিন দেখলেন, তা লিখেই চলছেন দুই প্রতিবেদক আহমেদ আল আমীন আর সোহেল।
ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতে শুরু করেছে শিশুটি। তাকে কোলে নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করতে এসেছেন বাবা। হাজারো রোহিঙ্গার ভিড় এড়িয়ে যদি ভাগ্যে কিছু জোটে, তবেই মিটবে এই শিশুর ক্ষুধা।
কুতুপালং গিয়ে দেখি লাখ লাখ মানুষ। সবাই খাবার চাইছে। এ যেন এক ক্ষুধার রাজ্যে প্রবেশ। মানুষ রাস্তার দুই পাশে অপেক্ষা করছে খাবারের জন্য। ব্যক্তি উদ্যোগে দেওয়া মানুষের খাবার কেউ পায়, কেউ পায় না। আর ছুড়ে দেওয়া খাবার নিয়ে চলে কাড়াকাড়ি।
ক্ষুধার জ্বালা যে কত বড় জ্বালা, তা দেখিয়ে দিলেন কুতুপালং এলাকার এই রোহিঙ্গা নারী। ত্রাণ নেওয়ার সময় হুড়োহুড়িতে মাটিতে পড়ে যাওয়া চিড়া কোনো রকমে তুলে মুঠোভরে খেতে শুরু করেন তিনি।
পঁয়ত্রিশ বছরের এক নারীকে দেখলাম মাটিতে পড়ে যাওয়া চিড়া কুড়িয়ে নিচ্ছেন। কাড়াকাড়ির একপর্যায়ে ওই চিড়ার প্যাকেটটি ছিঁড়ে যায়। একইভাবে মা ছুটছেন সন্তানের খাবারের জন্য, বাবা ছুটছেন, ভাই ছুটছেন।
ক্যামেরা তার কাজ করছে। ছবি তুলছি। দৃশ্যগুলো একে একে বন্দি হচ্ছে।
পরম মমতায় ছোট ভাইকে ত্রাণ হিসেবে পাওয়া খিচুড়ি খাইয়ে দিচ্ছে বড় ভাই। ক্যামেরায় সেই দৃশ্য ধারণ করতে গেলে ক্যামেরা দেখে কেঁদে ফেলে শিশুটি।
এক শিশুর সামনে গিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। শিশুটি ভয় পেয়ে গেল। কান্নাকাটি শুরু করল। তার বোন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে ওরা তোমাকে মারবে না।
শিশুটি থামেনি। কেঁদেই চলছে। বুঝলাম কী ভয়ানক পরিস্থিতি দেখে এসেছে সে। আর বিরক্ত করলাম না। থাকুক ও ওর মতো। নিরাপত্তাই বেশি প্রয়োজন ওর।
এভাবেই ক্যামেরার সামনে শিশুসন্তানের আগুনে পুড়ে যাওয়া পিঠ দেখাচ্ছিলেন এই বাবা। জানালেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী যখন তাদের বাড়িতে আগুন দেয় তখন ঘরের ভেতরেই ছিল শিশুটি। সেখান থেকে তাকে বের করে আনার আগেই ঝলসে যায় পিঠ।
আগুনে পুড়ে যাওয়া শিশুর পিঠ দেখাচ্ছিলেন এক বাবা। তাকে কোলে নিয়েই ত্রাণের জন্য ছুটছিলেন তিনি। ছবি তুলব কি না অনুমতি চাইলেই শিশুর পিঠটা দেখিয়ে দিলেন। বাংলাদেশে আসার আগে কোনো চিকিৎসাই পায়নি শিশুটি। এখানে এসে একটু ভালো আছে।
শাহ পরীর দ্বীপের দৃশ্য অন্যরকম। মানুষ দলে দলে আসছে। এরা নাফ নদী পেরিয়ে এসেছে। এক নারী হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁটছিলেন। কাদায় শরীর মাখামাখি। খেয়াল করে দেখি হাঁটুর পর থেকে তাঁর পা নেই!
দ্বীপের শেষ মাথায় নাফ নদী। ওখানেই জেটি। পাশেই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্প। নাফ নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছে এখনো জ্বলছে গ্রাম। ছবি তোলার চেষ্টা করি।
জেটিতেই দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় ১২ বছর বয়সী এক ছেলে। চোখটা নাফ নদীর ওপারে। জানাল, ওই পারেই তার গ্রাম। দুদিন আগে সে তার পরিবার নিয়ে নৌকায় পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সে জানাল, দূরে যে ধোঁয়া উড়ছে এটাই তার গ্রাম। পুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনারা।
ছেলেটি নিজ গ্রামে ফিরতে চায়। আবার স্কুলে ভর্তি হতে চায়। ‘শান্তি’ ফিরলে আবার দেশে যাবে সে।
নাফ নদীর পাড়ে পড়ে আছে বোরকা পরা এক নারীর লাশ। এর আগের রাতেই রোহিঙ্গাদের একটি নৌকা ডুবে যায়। সেখানেই ছিলেন ওই নারী।
দ্বীপে তিন রোহিঙ্গা নারী একটি গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিন বোনের কোলেই শিশু। তাঁরা নদী পার হয়ে এসেছেন। গরুটি সঙ্গে নিয়ে আসতে পেরেছেন। এখন গরুটি বিক্রি করতে পারলে তাঁরা বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাবেন। কক্সবাজারের কোনো ক্যাম্পে যাবেন। হাতে কিছু টাকা থাকলে সাহসও থাকে।
কিন্তু শিশুদের মুখ ছিল শুকনা। বোঝাই যায় অনেক সময় ধরে না খেয়ে আছে ওরা। সহকর্মী আল আমীন আমার জন্য একটি ছোট জুস নিয়ে এলেন। সেটি না খেয়ে শিশুদের দিলাম। ওরা হাতে নিয়েই খাওয়া শুরু করে। নিজে যে সারা দিন কিছু খাইনি, বিষয়টিই তখন ভুলে গেলাম।
এই সেই শিশু, নিজে না পান করে যার হাতে তুলে দিয়েছিলাম পানীয়র এই বোতলটি।
দৃশ্যগুলো এমন, অনেক কিছুই ভুলে থাকতে হয়, শক্ত থাকতে হয়। এগুলো ক্যামেরায় হয়তো ধারণ করা যায়, কিন্তু হৃদয়ে ধারণ করা অনেক কষ্টকর।